শহীদ কামরুজ্জামান আলম

০৯ অক্টোবর ১৯৭৩ - ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৩ | ৬৩

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

শাহাদাতের ঘটনা

শহীদ আবদুল মালেকের রক্তস্নাত পুণ্যভূমির জান্নাতি মিছিলে সংযোজিত হল আর একটি নাম- শহীদ কামরুজ্জামান আলম। শিবিরের শ্লোগান ‘ভালো মানুষ হওয়ার পাশাপাশি ভাল ছাত্র হওয়া’ এই মূলমন্ত্রের প্রতি আলম ভাইয়ের ছিল যথেষ্ট সচেতন। ‘আগে ছাত্র পরে শিবির’ এটা ছিল তার পথচলার দর্শন। কোন কারণে মন খারাপ হলে নিজের লেখাপড়ার ভেতর দিয়েই মনঃপীড়া দূর করার চেষ্টা করতেন। কিন্তু আবু জাহেলের উত্তরসূরিরা শহীদ কামরুজ্জামান আলম ভাইয়ের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হতে দেয়নি।

প্রাথমিক পরিচিতি
সাগরকন্যা খ্যাত পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার কপুলকাঠি গ্রামে ৯ অক্টোবর ১৯৭৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মুহাম্মদ জুলফিকার আলী এবং মাতার নাম মুসাম্মাৎ মমতাজ বেগম। বর্তমান আবাসস্থল ঢাকার মিরপুরের ১৩ নং সেকশনের টিনশেড কলোনির ২১৭ নং বাসা। এই বাসা থেকে শহীদ কামরুজ্জামান আলম ভাই ১৯৯৩ সালের ২৮ ডিসেম্বর তার মায়ের কাছ থেকে সংগঠনের কাজের জন্য বিদায় নিয়ে বের হন। শহীদ কামরুজ্জামান ভাইয়ের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে ভূমিকা রাখবে। সেজন্য গ্রামের বাড়ি ত্যাগ করে নিজেকে সৎ যোগ্য দক্ষ মানুষ হিসেবে গড়ার উদ্দেশ্যে রাজধানী ঢাকায় পাড়ি জমান।

শিক্ষাজীবন
৮ম থেকে দাখিল পর্যন্ত জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদ্রাসায় (১৯৮৮-১৯৯১) পড়ালেখা করেন। ১৯৯৩ সালে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করেন।

সাংগঠনিক জীবন
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ৬৩ তম শহীদ কামরুজ্জামান আলম সংগঠনের কর্মী ও একটি উপশাখার সভাপতি ছিলেন। তিনি সর্বদা মিষ্টভাষী, সদালাপী ও হাস্যোজ্জ্বল থাকতেন। ১৯৯৩ সালের ৭ মার্চ মায়ের কাছে লেখা চিঠি "বাড়ির কাজকর্ম মায়ের আদর যত্ন, তুচ্ছ ভালোবাসার চেয়ে আজ আমার নিকট সবচেয়ে প্রিয় হলো ইসলামী ছাত্রশিবিরের সকল প্রোগ্রামে উপস্থিত হওয়া এবং শিবিরের অফিসে যাতায়াত করা। পরম করুণাময় আল্লাহর নিকট আমার একটিই চাওয়া তিনি যেন আমাকে শহীদি কাফেলায় শামিল হওয়ার তাওফিক দান করেন"। যার মন প্রাণ সবসময়ই আন্দোলনের কাজ করার জন্য ব্যাকুল থাকত। তিনি ছিলেন সংগঠনের আনুগত্যশীল কর্মী।

শাহাদাতের ঘটনা
২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ সালে গাজীপুর জেলার টঙ্গীর দত্তপাড়ায় সন্ত্রাসীদের বোমার আঘাতে আহত হন। পরে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৯৩, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শাহাদাত বরণ করেন।

শহীদ আলম ভাইয়ের ডায়েরি থেকে
পড়ালেখার প্রতি গভীর ঝোঁক ছিল শহীদ আলম ভাইয়ের। কোন কারণে মন খারাপ হলে নিজের লেখাপড়ার ভেতর দিয়েই মনঃপীড়া দূর করার চেষ্টা করতেন। পরীক্ষার অনেক আগেই আলম ভাই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করতেন। আনন্দঘন বিয়ের দাওয়াতকেও লেখা-পড়ার আকর্ষণের কাছে হার মানতে হয়েছে।

ছাত্র হিসেবে দায়িত্বসচেতন আলম ভাইয়ের নিজস্ব মূল্যায়ন : (১৯৯৩ সালের ৪ জানুয়ারি লেখা)
‘আজ ঘ.উ.চ চেয়ারম্যান আনোয়ার জাহিদ ভাইয়ের ছেলের বিয়ে সন্ধ্যা ৭টার সময়। আমাকে সেখানে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পারলাম না একটি কারণে। তা হলো, মন ভালো ছিল না। তাই বাসায় বসে পড়ালেখায় মন বসাতে চেষ্টা করলাম। কেননা পরীক্ষার আর মাত্র ৫ মাস বাকি। এখন থেকে যদি ভালো করে পড়ালেখা না করি তবে পাস করা মুশকিল হবে। তাই লেখাপড়া করতে শুরু করলাম। আমাকে যে পরীক্ষায় ভালো পাস করতে হবে।’

বোধের নিক্তিতে শহীদ আলম ভাইয়ের ভেতর অগোছালো অসুন্দরেরা মাঝে মাঝেই তাকে মনঃকষ্টে ফেলতো। ইচ্ছে করতো সুদূর নির্জনতায় ডুবে যেতে তারপরও তিনি ভালবাসতেন এই অপূর্ব পৃথিবী।

পৃথিবীটা মাঝে মাঝে যেমন অনেক সুন্দর লাগে তেমনি অনেক খারাপও লাগে। এক এক সময় মনে হয় এই পৃথিবী ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। যেখানে কোনো হিংসা কোনো ঝগড়া কোনো কলহ থাকবে না। থাকবে শুধু ভালবাসা, প্রেম, নিরিবিলি পরিবেশ। যেখানে বসে একা একা অনেকক্ষণ চিন্তা করতে পারব। কবিতা লিখতে পারব সেই সুন্দর স্থানে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এই সুন্দর স্থানটি এই পৃথিবীতে মিলবে? পৃথিবীটা আসলে অনেক সুন্দর। কিন্তু এখানকার মানুষগুলি অনেক খারাপ। আর এদের কারণেই এই সুন্দর পৃথিবী আজ এক করুণ রূপ ধারণ করেছে।

কথায় বলে মরণের খবর জানে চরণে। শহীদ আলম ভাই কি তাঁর মৃত্যুর ঘনঘটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। হয়তো তাই হবে। অস্বাভাবিক মৃত্যু তার পিছু ধাওয়া করেছে জেনেও তিনি সে মৃত্যুকে লেখনীর মাধ্যমে স্বাগত জানান।

১৯৯৩ সালের ১৫ জানুয়ারি লেখা
‘মাঝে মাঝে ভয় হয়। মনে হয় আমি হঠাৎ মরে যাবো। হয়তোবা কোনো দিন পেপারে আমার ছবি উঠবে। সেখানে লেখা থাকবে যে সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত।’

শহীদ আলম ভাই বই পড়তেন খুব বেশি। কবিতা লেখার মধ্য দিয়ে তিনি মনের কান্তি দূর করতেন। সাধারণ জ্ঞান চর্চার প্রতি ছিল তার অসাধারণ আগ্রহ। ঝালমুক্ত খাবারের মধ্যে ডাল, আলুভর্তা ছিল তার প্রিয় খাবার। মাছের মাথা দেখলে লোভ সামলাতে পারতেন না।

জানাযা ও দাফন
অনেক লোকের সমাগমের মাধ্যমে জানাযা নামায অনুষ্ঠিত হয় প্রিয় আলম ভাইয়ের। পরে ঢাকার মিরপুর ১১-স্থ সরকারি কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়।

শহীদের আকাঙ্ক্ষা 
শহীদ হওয়ার পূর্বে সবসময় মায়ের কাছে শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতেন। এবং শহীদদের ইতিহাসের কথা আলোচনা করতেন।

শহীদের পিতার মন্তব্য
আল্লাহ তাকে যেন শহীদ হিসেবে কবুল করেন এবং জান্নাত দান করেন।

একনজরে শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান আলম
নাম : মুহাম্মদ কামারুজ্জামান আলম
পিতার নাম : মো. জুলফিকার আলী
মাতা : মোসাম্মাৎ মমতাজ বেগম
বর্তমান ঠিকানা : বাসা-২১৭ (টিনশেড কলোনি), সেকশন-১৩, মিরপুর, ঢাকা।
স্থায়ী ঠিকানা : গ্রাম- কর্পুলকাঠি, পো-কালিয়া, থানা-বাউফল, জেলা- পটুয়াখালী।
জন্মতারিখ : ৯ অক্টোবর ১৯৭৩ ইং।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : ৮ম থেকে দাখিল পর্যন্ত জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া মাদরাসা (১৯৮৮-১৯৯১ ইং)। এইচএসসি পাস করেন আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে ১৯৯৩ সালে।
সর্বশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, অনার্স ১ম বর্ষ (তৎকালীন কলেজ)
ভাইবোনের সংখ্যা : ভাই ৩ জন শহীদ কামরুজ্জামান আলম (বড়), শামসুজ্জামান, নুরুজ্জামান
আহত হওয়ার তারিখ ও স্থান : ২৮ ডিসেম্বর ১৯৯৩ ইং, দত্তপাড়া, টঙ্গী, গাজীপুর।
শহীদ হওয়ার তারিখ ও স্থান : ৩১ ডিসেম্বর, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে
দাফন : সরকারি কবরস্থান, মিরপুর-১১, ঢাকা।
সাংগঠনিক মান : কর্মী
সর্বশেষ দায়িত্ব : উপশাখা সভাপতি
শহীদের শখ : বইপড়া, কবিতা লেখা।
প্রিয় রঙ : নীল (শাহাদাতের সময় পরনে ছিল নীল রঙের শার্ট-প্যান্ট)
প্রিয় খাবার : মাছের মাথা ও ঝাল জাতীয় খাবার।
অন্যান্য কৃতিত্ব : সংস্কৃতিতে বিশেষ কৃতিত্ব।
যে শাখার শহীদ : ঢাকা মহানগরী উত্তর।

এক নজরে

পুরোনাম

শহীদ কামরুজ্জামান আলম

পিতা

মোঃ জুলফিকার আলী

মাতা

মোসাম্মৎ মমতাজ বেগম

জন্ম তারিখ

অক্টোবর ৯, ১৯৭৩

ভাই বোন

৩ ভাই

স্থায়ী ঠিকানা

করপুলকাঠি, কালিয়া, বাউফল, পটুয়াখালী

সাংগঠনিক মান

কর্মী

সর্বশেষ পড়ালেখা

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (তৎকালীন কলেজ) অনার্স ১ম বর্ষ

শাহাদাতের স্থান

টঙ্গীর দত্তপাড়ায় আহত হন, শাহদাত বরণ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ।