বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল ২০১৬

আতঙ্কের জনপদ ঝিনাইদহ : একের পর এক ছাত্র হত্যা

গণতন্ত্রবিহীন একটি দেশের অবস্থা কেমন হতে পারে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি যেন তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি। ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধমে ক্ষমতা দখল করে রাখা অবৈধ আওয়ামী সরকার বাকস্বাধীনতা হরণ, মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার, রিমান্ড এবং গুম-খুনের মধ্যদিয়ে দেশে কায়েম করেছে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। বিরোধীদল ও ভিন্নমতের মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে যত্রতত্র, খালে-বিলে। রাষ্ট্রীয় মদদে ক্রসফায়ারের নামে টার্গেট কিলিং দিন দিন বেড়েই চলছে। কখনো সাতক্ষীরা, কখনো গাইবান্ধা আবার কখনো ঝিনাইদহ একের পর এক জনপদ রক্তাক্ত হচ্ছে। কোন কোন স্থানে এটি পরিনত হয়েছে গণহত্যায়।

প্রতিদিনই খালি হচ্ছে অসংখ্য মায়ের বুক:
প্রথমে সাদা পোষাকের পুলিশ পরিচয়ে গ্রেপ্তার, তার কয়েকদিন পর মিলছে লাশ। এটি এখন বাংলাদেশের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। ক্ষমতার আসনকে পাকাপোক্ত করতে প্রতিদিনই খালি হচ্ছে কোন না কোন মায়ের বুক। জালিম সরকারের রক্ত পিপাসা দিন দিন যেন বেড়েই চলছে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকুরীজীবি, আলেম ও সাধারণ মানুষ সহ তাদের গুম-খুনের কবল থেকে রেহাই পাচ্ছে না কেউ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী শুধুমাত্র ২০১৫ সালেই বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ডের শিকার হন ১৯৩ জন বা তারও বেশী। যার মধ্যে ১৪৩ জনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ক্রসফায়ারে হত্যা করে। এদের বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম দেশে কেন এই বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড? আর কত মায়ের বুক খালি হলে বন্ধ হবে এই জঘন্য রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস?

বর্বরতার প্রতিচ্ছবি ঝিনাইদহ:
ছেলের চিৎকার শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন মা। দেখেন, ছেলের হাতে হাতকড়া। পাশে দুটি মোটরসাইকেল। চালকের আসনে দুজন। আরও দুজন আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে আছেন তার একমাত্র ছেলেকে। মা কিছুই বোঝেন না। জড়িয়ে ধরেন ছেলেকে। আর্তনাদের সঙ্গে আগন্তুকদের জিজ্ঞেস করেন, তোমরা আমার ছেলেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? অনুনয়-বিনয় করে বলেন, আমার ছেলেকে রেখে যাও। কিন্তু সেই মায়ের আর্তনাদ আর অনুনয়-বিনয়ে মন গলেনি তাদের। নিজেদেরকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে দ্রুত এলাকা ছাড়ে মোটরসাইকেল বাহিনী। পরে ২৬ দিন নিখোঁজ থাকার পর ছেলের গুলিবিদ্ধ লাশ মিলেছে ১২ এপ্রিল। এ ধরনের ঘটনা এখন নিয়মিতই ঘটছে ঝিনাইদহে।

বিগত ২/৩ বছরে ঝিনাইদহে ডিবি পরিচয়ে ২৭ জনকে অপহরণ করা হয়, যার মধ্যে লাশ মিলেছে ২৪ জনের। সর্বশেষ গত দেড় মাসে লাশ পাওয়া যায় হাফেজ জসীম উদ্দিন, আবু যর গিফারী, শামীম হোসেন ও মহিউদ্দিন সোহান নামের চার মেধাবী ছাত্রের। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন আইয়ুব, আজাদ হোসেন এবং মোফাজ্জেল হোসেন। এমতাবস্থায় আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে পুরো জেলা। এসব অপহরণ বা তুলে নেয়ার অধিকাংশই প্রকাশ্যে ঘটলেও ভয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চাচ্ছেন না। একের পর এক গণহত্যার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও সরকার তা আমলে নিচ্ছে না। করা হয়নি কোন হত্যার বিচার।

গ্রেপ্তারের পর পুলিশের ধারাবাহিক অস্বীকার ও মায়ের বুক থেকে ছিনিয়ে নিয়ে হত্যা:
ধারাবাহিক গুম-খুনের ঘটনার সর্বশেষ কয়েকটি হচ্ছে- গত ১২ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ তারিখে হাফেজ জসীমকে ডিবি পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করার ২১ দিন পরে ৩ মার্চ গভীর রাতে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারী ২০১৬ তারিখে ঝিনাইদহ জেলার কুঠিদুর্গাপুর মাদ্রাসার শিক্ষক আবু হুরায়রাকে তার কর্মস্থল থেকে গ্রেপ্তার করে গুম করে ডিবি পুলিশ, ৩৬ দিন পর তার লাশ যশোরের চৌগাছা সড়কের পাশে থেকে উদ্ধার করা হয়। গত ১৮ই মার্চ ২০১৬ তারিখে শুক্রবার জুম্মার নামাজ শেষে ৪ জন ব্যক্তি পুলিশ পরিচয়ে মায়ের ধরে থাকা অবস্থায় তুলে নিয়ে গুম করার ২৬ দিন পরে ১২ এপ্রিল গভীর রাতে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়। একই কায়দায় গত ২৫ মার্চ ২০১৬ তারিখে শামীম হোসেনকে পুলিশ পরিচয়ে গুম করার ২৬ দিন পরে ১২ এপ্রিল গভীর রাতে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা হয়। দুই ছাত্রের রক্তের দাগ না শুকাতেই গত ২০ এপ্রিল ২০১৬ তারিখে ঘাতকের নির্মমতার শিকার হয় আরেক মেধাবী ছাত্র মহিউদ্দিন সোহানকে যাকে একইভাবে ১০ এপ্রিল পুলিশ পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করার ৯ দিন পরে গুলি চালিয়ে তাকে হত্যা করা হয়।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ভিকটিমদের প্রত্যেকের পরিবার নিখোঁজের পরে তাদের অবস্থান জানতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করলে তারা তাদের গ্রেপ্তারের কথা সম্পূর্ন অস্বীকার করে। এমনকি অধিকাংশ ভিকটিমের জন্য থানায় কোন জিডি পর্যন্ত নেয়া হয়নি, নেয়া হয়নি কোন উদ্ধার তৎপরতা। প্রকাশ্যে দিবালোকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের সরাসরি অস্বীকার ও আদালতে হাজির না করা নিয়ে নানা আশঙ্কার জন্ম দেয়। পরিবারের পক্ষ থেকে উদ্বেগ এবং তাদের সন্ধানের দাবী জানিয়ে বিবৃতি প্রদান করা হয়। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ছেলেদের সন্ধানের দাবীতে প্রশাসন ও প্রভাবশালীদের কাছে ধর্ণা দিয়েও পরিবারের কোন লাভ হয়নি। প্রত্যেকের গুম হওয়ার ঘটনা, পুলিশের অস্বীকার, গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়ার ঘটনা একই রকম।

কারা চালাচ্ছে এই গণহত্যা:
প্রতিটি হত্যার ধরণ একই। কলেজ ছাত্র সোহানকে অপহরণের সময় প্রত্যক্ষদর্শীরা কালীগঞ্জ থানার এস আই নীরব ও এ এস আই নাসিরকে চিনতে পারে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, এটি একটি পরিকল্পিত সংঘবদ্ধ হত্যাকান্ড এবং এতে পুলিশ সরাসরি জড়িত। কিন্তু সরকারের নির্দেশ ছাড়া শুধু পুলিশের পক্ষে এত বড় গণহত্যা চালানো কি সম্ভব? এটি এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট সরকারের নির্দেশেই পুলিশ ঝিনাইদহে একের পর এক গণহত্যা চালাচ্ছে। ভবিষ্যতে প্রতিফোঁটা রক্তের হিসাব আজকের ক্ষমতাসীনদের দিতে হবে।

সচেতন দেশবাসীর প্রতি আহবান:
একের পর এক হত্যাকান্ডের মধ্যদিয়ে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে পুরো ঝিনাইদহ। শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে ভিন্নমতের মানুষগুলোকে রাতের আঁধারে ক্রসফায়ারে হত্যা করছে। যা সুষ্পষ্টভাবে গণহত্যার শামিল ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিচার বর্হিভূত হত্যাকান্ড বন্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করলেও সরকার তা মানছেনা। আমরা অবিলম্বে এই পরিকল্পিত গণহত্যা বন্ধ করার দাবী জানাচ্ছি। সেই সাথে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জসীম উদ্দিন, আবু যর গিফারী, শামীম হোসেন ও মহিউদ্দিন সোহান সহ সকল ছাত্র হত্যাকারী পুলিশ সদস্যদের গ্রেফতার ও বিচারের আওতায় আনার দাবী জানাচ্ছি।
এই দানবীয় শক্তিকে রুখতে দেশের বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকার সংস্থা, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের সচেতন নাগরিকদের এই রাষ্ট্রীয় হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানাচ্ছি। সেই সাথে জাতিসংঘসহ সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনকে এই হত্যাযজ্ঞ বন্ধে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করার আহবান জানাচ্ছি।

প্রচারে: সচেতন ছাত্র সমাজ

সংশ্লিষ্ট