শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪

মুহাম্মদ জাহিদুর রহমান

রক্তের ঋণ শোধ হয় না

ঐতিহাসিক ২৮ অক্টোবর আমাকে আজো তাড়িয়ে বেড়ায়। অক্টোবরের সেদিনের শহীদেরা তো আমারই সামনে থেকে চলে গেল এক সাফল্যমণ্ডিত ঈর্ষনীয় শান্তির নিড়ে। আমাদের সামনে তাদের ওপর যেভাবে দানবীয় কায়দায় আক্রমণ করা হলো তাদের জন্য আমরা কী করতে পেরেছি? শাহাদাতের পর তাদের ইচ্ছা ও আকুতিগুলো এখনো তো আমাদের কানে ভাসছে, আমরা কি পারছি এ বিরাট বোঝা বহন করতে? অথবা আমরা কি আসলেও ততটা যোগ্য সে কাজের, যে মহান দায়িত্ব ওরা চাপিয়ে দিয়ে গেল আমাদের কাঁধে।

এই তো বেশ ক’টি ঈদুল ফিতর উদযাপিত হলো তাদের শাহাদাতের পর। পরিবারগুলোয় কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে, সেই চিরচেনা থাকার ঘর, পড়ার টেবিল, ভোর বিহানে মাকে সালাম করে ঈদগাহে যাওয়া, বিকেল বেলা বন্ধুদের সাথে আনন্দভ্রমণ, ঈদের মাঠে কুরআন-হাদিস সমৃদ্ধ বক্তব্য উপস্থাপন- এসবই এখন স্মৃতি।

সে দিনের লগি-বৈঠার হিংস্র প্রদর্শনী সকালবেলায়ই আমাদের চোখে পড়ে। সকাল সাড়ে ১০টার মতো হবে, আমি কেন্দ্রীয় সভাপতির অনুমতি নিয়ে পল্টন মোড়ের অবস্থা জানার জন্য সেখানে চলে আসি। এসেই চারপাশ দেখেই দিনের ভয়াবহতা বুঝতে বাকি থাকলো না। আমাদের কর্মী ভাইয়েরা মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে আর বিজয়নগরের দিক থেকে ২০০ জনের মত লোক নিয়ে ১৪ দলের একটি মিছিল মুক্তাঙ্গনমুখী। মোড়ে এসেই বৈঠাগুলো আমাদের ভাইদের দিকে ছোড়া শুরু হয়ে গেল। এই শুরু হলো মারামারি, এর পরের ঘটনা তো সকলেরই জানা। এরপর তো এক পাশে মানবঢাল আর অপর পাশে গুলি, বোমা ও অস্ত্র, ছোরা এবং বৈঠার তাণ্ডব। একে একে মুজাহিদ, মাসুম, শিপন, জসিম (১), জসিম (২) এর শাহাদাতের নজরানা, অসংখ্য ভাইয়ের হাত, পা চোখ, মাথা সারা শরীর গুলির আঘাতে জর্জরিত, শুধু রক্ত আর রক্ত! কারবালা আমরা দেখিনি কিন্তু ২৮ অক্টোবর পল্টনে হত্যাকাণ্ড দেখেছি, মানবতার সবচেয়ে পৈশাচিক আচরণ লাশের ওপর দানবীয় নর্তন দেখেছি, গণতন্ত্রের করুণ মৃত্যু দেখার সুযোগ হয়েছে ১৪ দলীয় তথা আওয়ামী কসাইদের হিংস্র আক্রমণের ফলে।

আমাদের প্রিয় মুজাহিদের শাহাদাতের খবর কানে আসতেই জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ভাইয়ের নিকট পুলিশি সহায়তার কথা বলতে যাই। সেখানে গিয়ে আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। চিৎকার করে কান্নাকাটি করে বলছিলাম, ‘আমাদের ভাইদের মেরে ফেলা হচ্ছে। প্লিজ পুলিশের ব্যবস্থা করুন।’ আমার তখন জানা ছিল না মুজাহিদ ভাই ততক্ষণে অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। আমাকে জোরে ধমক দিয়ে বলছিলেন, ‘জাহিদ! নেতাদের ভেঙে পড়লে চলবে না।’

এত স্বাভাবিকভাবে তিনি কথাটি আমাকে বললেন যে, পরবর্তীতে চিন্তা করে বিস্মিত হয়েছি। নিজের সন্তানের চেয়েও প্রিয় সংগঠনের শত শত কর্মীর আহত হওয়ার দৃশ্য অবলোকন করা, তাদের যন্ত্রণাকাতর শব্দ কানে শেলের মতো বিদ্ধ হওয়ার পরও এত স্বাভাবিক একজন মানুষ কিভাবে থাকতে পারে। পরক্ষণে অবশ্য বুঝেছি, একেই বলে দায়িত্বশীলের দৃঢ়তা, দূরদর্শিতা ও নেতার গুণ।

যথারীতি খবর দিয়ে দৌড়ে চলে যাই পল্টন মোড়ে, সেখানে গিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতিকে জানাই যে, নোয়াখালী হোটেলের গলিতে দু’দিক থেকে আক্রমণের শিকার হয়েছেন আমাদের ১২-১৪ জনের একটি গ্রুপ। কেন্দ্রীয় সভাপতির নির্দেশক্রমে আরও ক’জন দায়িত্বশীল ভাইকে সাথে নিয়ে ওদিকে চলে যাই। সেখানে যাওয়ার পথে দেখতে পাই ওপর থেকে পাথর নিক্ষেপ আর আহত, রক্তরঞ্জিত ভাইদের সারি। ওহ! আর বর্ণনা করা যায় না। সত্যিই সেদিন আমাদের নেতৃবৃন্দ যদি দৃঢ় এবং স্বাভাবিক না থাকতে পারতেন, ঘটনা আরও ভয়াবহ হতে পারতো।

আমাদেরকে জানানো হলো, পূর্বঘোষিত সময়েই সমাবেশ শুরু হবে এবং আমীরে জামায়াতও যথারীতি বক্তব্য রাখবেন। স্বাভাবিকভাবেই একটু বেশি সতর্কাবস্থান গ্রহণ করার জন্য সকল জনশক্তিকে বলে দিয়েছি। এর আগেই আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, আমীরে জামায়াত সমাবেশে আসার সাথে সাথে ১৪ দলের সকল শক্তির সমন্বয়ে চূড়ান্ত আক্রমণ চালানো হবে। এত রক্ত, আহত, শাহাদাতের সংবাদ শোনার পর তাদের চূড়ান্ত হামলার কথা জেনে আমরাও স্বাভাবিক একটি খবর হিসেবে নিয়ে আল্লাহর ওপর ভরসা করে অটল দাঁড়িয়ে থাকলাম ময়দানে।

যেই কথা সেই কাজ। আমীরে জামায়াতও দাঁড়িয়েছেন। আর শুরু হলো পল্টন মোড় থেকে দ্রিম দ্রিম বোমা বিস্ফোরণ। সে কী শব্দ, আর ধোঁয়া। একটি বোমার ধোঁয়ায় এলাকা ভরে যায়, সেই ধোঁয়া মিলিয়ে যাওয়ার আগে কখনো সাথে সাথে আবার আরও একটি বোমা।  বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এই বোমার বিকট শব্দে আমাদের জনশক্তি সন্ত্রস্ত না হয়ে সেই ধোঁয়ার মধ্যেই বোমাবাজদের ধরার জন্য দৌড়ে সামনে যাচ্ছিল। ওদিকে আমীরে জামায়াত তার স্বভাবসুলভ দৃঢ়চিত্তে দরাজকণ্ঠে সকল প্রকার উত্তেজনাকর শব্দ পরিহার করে সাবলীলভাবে গঠনমূলক বক্তব্য প্রদান করে যাচ্ছিলেন।

যখন তিনি বক্তব্য রাখছেন ততক্ষণে সেই ভোর থেকে চলমান হামলার মোকাবেলা করতে তার হাতেগড়া বাগানের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি গোলাপ ঝরে গেছে এবং আমীরে জামায়াতের নিকট খবর ছিল যে, শিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল শাহাদাতবরণ করেছে। আমীরে জামায়াত ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীলদের যে কী পরিমাণ ভালোবাসেন তা কোন সময়ের দায়িত্বশীলই শত চেষ্টার পরও ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। আর কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারি জেনারেলের কথা তো বলাই বাহুল্য। একজন দায়িত্বশীলের শাহাদাতের সংবাদ শোনার পরও উত্তেজিত না হয়ে, প্রতিহিংসাপরায়ণতা পরিহার করে, বেআইনিভাবে প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য জনশক্তিকে উদ্বুদ্ধ না করে, আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত না করে, দেশের উন্নয়ন অগ্রগতির কথা, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার আহ্বান, সামাজিক শন্তি শৃঙ্খলা আর নিরাপত্তার কথা বলা, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কথা বলা, সংবিধান ও স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান জানানো সত্যিই কঠিন। এটাই হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে জাতীয় নেতার ভাষণ। পরবর্তীতে সিডিতে যারা দেখেছেন, তারাও নিশ্চয়ই সাক্ষ্য দেবেন দেশপ্রেম কাকে বলে তা আমীরে জামায়াতের সেদিনের বক্তব্যে বোঝা গেছে।

এ হামলা যে আসলে কোন নির্দিষ্ট দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে নয় বরং সামগ্রিকভাবে দেশকে আবার পরাধীন বা পুতুল রাষ্ট্রে পরিণত করার এবং ইসলামের পক্ষে কথা বলার কণ্ঠগুলোকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্যই যে পরিচালনা করা হয়েছিল তা মনে হয় আজকে সচেতন পাঠকের নিকট নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে।

যুগে যুগে ইসলাম এবং ইসলামের পক্ষে কথা বলার লোকদেরকে আল্লাহ তায়ালা নিজহাতে যেভাবে হেফাজত করেছেন, সেদিনের পল্টন ময়দানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ইতিহাসেরও এমন জঘন্যতম একটি হত্যাকাণ্ডের ক’বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও হত্যাকারীদের নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ানো- বিচারের বাণী নিভৃতে ক্রন্দনের মতোই। এসবের কারণে আমরা যারা শহীদদের উত্তরসূরি তারা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে দাবি তুলতে পারি যে, অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো মীমাংসা অতীব জরুরি।

২৭ অক্টোবর রাতে পুলিশের আইজি ঘোষণা করেন আগামীকাল মাঠপর্যায়ের সকল পুলিশ সদস্য জিরো টলারেন্সে (কঠোর অবস্থানে) থাকবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন একটি চূড়ান্ত ঘোষণার পরও পুলিশ সদস্যবৃন্দ নিষ্ক্রিয় থেকে হামলাকারীদের পক্ষাবলম্বন কেন করলো? তাহলে আইজিপি’র ওপরও কি কোন নির্দেশ ছিল? অথবা আইজিপিকে টপকিয়ে কোন নির্দেশ কি মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তার নিকট ছিল?

মালিবাগ হত্যাকাণ্ডের নায়ক দুলালকে দীর্ঘ ৬ বছর পর যে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা গ্রেফতার করে দক্ষতার পরিচয় দিলেন, তারা কি মাত্র ক’ বছরের পুরনো সন্ত্রাসী, খুনিদের গ্রেফতার করতে পারবেন না? তাদের তৎপরতায় শহীদদের পরিবার ও সাথীরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না কেন?

বাংলাদেশের সাবেক সেনাপ্রধান আমেরিকার একটি সমাবেশে বলেছিলেন, ২০০৬ সালে ঢাকায় যেভাবে রাস্তার ওপর মানুষ হত্যা করা হয়েছে, আমার লাইফে কোন মানুষ কেন, কোন পশুকেও এ রকম নৃশংসভাবে হত্যা করতে দেখিনি। এই বক্তব্য নিহতদের পরিবারের প্রতি অবশ্যই গভীর সমবেদনাজ্ঞাপক। কিন্তু এই শহীদ পরিবারগুলো কি তাদের সন্তানদের হত্যার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রত্যাশা করতে পারে না?

শহীদের মায়েদের বলছি, যাদের আমরা মা বলার সাহস করি, যে সন্তানটি জন্মেছিল আপনার জঠরে, সে এখন দেশের কোটি মায়ের প্রিয়তম সন্তান, যে সোনামণিটি আপনার ঘরকে আলোকিত করবে বলে ভেবেছিল, সে আজ উজ্জ্বল সূর্য হয়ে এ ভূখণ্ডের প্রতিটি ঘরে আঁধার বিতাড়ন করছে, যে সন্তানটি আপনার চক্ষু শীতল করতো সে আজ গোটা মানবতা ও মনুষ্যত্বের জন্য শান্তির দূত হয়ে ফিরছে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে।

আমাদেরও মা এখন আপনি। আমরা জানি না আমাদের মা ডাক আপনাকে সান্ত্বনা দেয় কি না। আপনার অযোগ্য সন্তানদের কারো চেহারায় আপনার নাড়ির টান অনুভব করেন কি না। তারপরও এ অধমের বিনীত অনুরোধ, আপনাকে মা বলে ডাকার অধিকারটুকু থেকে আমাদের বঞ্চিত করবেন না।