সুখ, শান্তি ও শিক্ষা - ড. আহসান হাবীব ইমরোজ
সুখ ও শান্তি। ছোট্ট দুটি শব্দ। কিন্তু এই পরমাণুসম শব্দ দুটিতেই লুক্কায়িত আছে মানুষের দুনিয়া এবং আখেরাতকেন্দ্রিক সকল কার্যক্রমের মূলীভূত লক্ষ্য। এমনকি সমগ্র মহাবিশ্বের কোটি কোটি মাখলুকও এর বাইরে নয়। বাড়ি, গাড়ি, ধন, খ্যাতি মানুষকে সুখ-শান্তি দেয় এটি মানুষের আপাত: বিশ্লেষণ। আর তাই বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ এগুলি যেন তেন প্রকারে অর্জনের জন্য মারাত্মক এক ম্যারাথনে লিপ্ত। শুধু কি তাই? দুনিয়ার সকল বিভ্রাট, হট্টগোল, মারামারি এমনকি যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ সবই কিন্তু তাদের জনকদের ভাষায় এই সুখ আর শান্তির জন্যই। আজকে ইরাক, আফগানিস্তানে ধ্বংসযজ্ঞ, চেচেন, বসনীয়, কাশ্মীরী আর ফিলিস্তিনিদের হত্যাযজ্ঞ সবই এসবের স্রষ্টাদের ভাষায় বিশ্বশান্তির জন্য। এমনকি দু'দুটি বিশ্বযুদ্ধের মহানায়করা এই শান্তির বাহানাতেই কোটি কোটি নিরীহ মানুষদের রক্ত ও লাশের হোলিখেলায় মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু যুদ্ধের স্রষ্টারা কি সুখ-শান্তিনামক সোনার হরিণটি ছুতে পেরেছেন? সম্ভবত নয়, বেশি দুরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই এইতো আমাদের নিজের দেশেই ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকাননে যারা বাংলার স্বাধীনতা সূর্যকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অস্তমিত করেছিল। তারা সাময়িকভাবে আকাশছোঁয়া লুণ্ঠিত ধন-সম্পদ আর অকল্পনীয় ক্ষমতার অধিকারী হলেও ইতিহাস সাক্ষী তাদের প্রত্যেকের পরিণতি হয়েছিল ভয়ঙ্কর ধ্বংস।
পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না
(এএফপি)-আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া (ইউএসসি) এর গবেষকরা “ক্যাম্পেইনিং হ্যাপিনেস” শীর্ষক গবেষণায় দেখেন ‘অধিকাংশ মানুষই যত ধনী হয়ে ওঠে তত সুখী হয় না'। ২০০৩ এর আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স এর ওয়েবসাইটে এ সম্পর্কে জানা যাবে। গবেষণায় দেখা যায়, সুখী হওয়ার কোন নির্ধারিত মাত্রা নেই। ১৯৭৫ সাল হতে প্রতি বছর ১৫০০ লোকের ওপর এ জরিপ চালানো হয় । জরিপের ডাটা বিশ্লেষণকারী ইউএসসি'র অর্থনীতিবিদ রিচার্ড ইস্টারলিন বলেন, অনেকের মধ্যেই এই মোহ কাজ করে যে, আমরা যত অর্থ উপার্জন করবো ততই সুখী হব। তিনি বলেন, আমরা আমাদের পরিবার ও স্বাস্থ্যের বিনিময়ে অর্থ উপার্জনে সমস্ত সম্পদ বিনিয়োগ করি। সমস্যা হচ্ছে উপার্জন বাড়ার সাথে সাথে আমাদের চাহিদাও যে বেড়ে যায় তা আমরা বুঝতে পারি না। গবেষণায় দেখা যায় সুখী হওয়ার প্রধান কারণ গুলি হচ্ছে, ১.‘প্রিয়জনের সাথে সুখময় সময় কাটানো ২. সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া ৩. বন্ধুবাসলতা ৪.আশাবাদী মন ৫ . আত্মনিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা তথা ধৈর্য ৬. নীতিজ্ঞানে সমৃদ্ধ এবং ৭. নিজের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল ব্যক্তিরাই সুখী হন।
অপর দিকে ধন, যশ, খ্যাতির ভেতর যারা সুখ খুঁজেছেন তারা ব্যর্থ হয়েছেন বিশ্বখ্যাত অনেক চিত্রতারাকা, আর্নেস্ট হোমিংওয়ে, কাওয়াবাতার মতো নোবল পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যিক এবং হুন্দাই কোম্পানির মালিকের মত শ্রেষ্ঠ ধনীদের আত্মহত্যাই-এর প্রমাণ। তাই কিসে সুখ-শান্তি এটি পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল এবং সবচেয়ে দামি প্রশ্ন। পৃথিবীর লাখো দার্শনিক ও ঋষিদের মাথার চুল পেকে গেছে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে। যেমন বিশ্বজয়ী আলেকজাণ্ডারের শিক্ষক এরিস্টটল বলেন “সুনিয়ন্ত্রিত কর্মের মধ্যে দিয়ে আত্মার অনুভবের প্রকাশই হচ্ছে সুখ” প্রায় এক হাজার বিলোনিয়ার তৈরি করেছিলেন যে মার্কিন আয়রন কিং সেই এন্ড্রু কার্নেগি বলেন “সুখের সবচেয়ে গূঢ় রহস্য হল ত্যাগ।” ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব এর ভাষায় “নিজের চাহিদা কমিয়ে আনার মত সুখ আর নেই। সেই হচ্ছে আসল সুখ। বিশ্ববিখ্যাত নোবল বিজয়ী সাহিত্যিক লিও টলস্টয় যিনি ছিলেন জমিদার পুত্র কিন্তু বেছে নিয়েছিলেন ঋষির বেশ তিনি বলেন “অল্পেতে তুষ্ট থাকতে পারলেই জীবনকে মধুময় মনে হয়। ”
কবি কামিনী রায় বলেন
“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি
এ জীবন মন সকলি দাও ;
তার মত সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভূলিয়া যাও”।
সবশেষে হাদিসে বলা হয়েছে আত্মার অভাব মুক্তিই হচ্ছে সত্যিকার সুখ তাই মানুষের দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে সত্যিকার সুখের জন্য দরকার আলোকিত জীবন। আর এই আলোকিত জীবনের জন্যই সবার আগে দরকার যে অনুষঙ্গ তার নাম শিক্ষা। সত্যিকার শিক্ষা ও শান্তি পারস্পরিক সম্পর্কিত দু'টি বিষয়। প্রচণ্ড জিনিয়াস বা স্মরণশক্তিসম্পন্নদের নিয়ে গবেষণা করেছেন আমেরিকার এক্টোর ইউনিভার্সিটির প্রফেসর মাইকেল হাও। তিনি কিছু কথা বলে সারা বিশ্বে ঝড় তুলেছেন “সাধারণ মানুষ ও জিনিয়াসদেও ভেতর কোন পার্থক্য নেই”। তার মতে জিনিয়াসরা প্রত্যেকেই তৈরি হয়। তবে একটি বিষয়ের ওপর তিনি খুবই গুরুত্ব দেন, সেটি হলো পারিবারিক শান্তি । যে পরিবারে যত বেশি শান্তি আছে এবং যেখানে ছোট ছেলেমেয়েরা যতবেশি হাসিখুশি পরিবেশের মধ্যে বড় হতে পারে সে পরিবার থেকে ততবেশি জিনিয়াস জন্ম নেয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ক্ষেত্রে জীবনসঙ্গীর অনুপ্রেরণাও অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রফেসর হাও ব্রিলিয়ান্ট সাইন্টিফিক মাইণ্ড নিয়েও কাজ করেছেন। আইনস্টাইন সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, তার পরিবারের পরিবেশ ভাল ছিল এবং সেখান থেকে তিনি প্রচুর উৎসাহ পান যা তাকে জগৎবিখ্যাত হতে সহায়তা করে। প্রফেসর হাও এর মতে একজন মানুষের সাফল্যের মূল বিষয় হচ্ছে “ব্যক্তিগত পরিশ্রম, কাজ করার সুযোগ, পারিবারিক উৎসাহ এবং শান্তি”। তিনি আরো জোর দিয়ে বলেন পরিবারে টাকার চেয়ে শান্তির বেশি প্রয়োজন। প্রফেসর হাও তার নিজের লেখা বই ‘হাউ টু বি এ ক্রিয়েটিভ জিনিয়াস ইন টেন ইজি স্টেজেস,’ ‘গিভ ইউর চাইল্ড এ বেটার স্টার্ট,' জিনিয়াস এপেইহু এগুলিতে তিনি আরো বিস্তারিতভাবে উপরোক্ত বিষয়গুলি উল্লেখ করেছেন।
শিক্ষা ও সভ্যতা একই সূত্রে গাথা । বর্তমান মানব সভ্যতা শিক্ষারই ফলশ্রুতি। চলমান সময়ে অগ্রসরমান এই পৃথিবীতে শিক্ষা সবচাইতে আকর্ষণীয়, সবচাইতে আলোচিত এবং সবচাইতে ব্যবহৃত এক অনুষঙ্গ।
শিক্ষা কী ও কেন?
বাংলা শিক্ষা শব্দটি এসেছে সংস্কৃত শাস ধাতু হতে। শাস ধাতুর অর্থ হচ্ছে শাসন করা, নিয়ন্ত্রণ করা, নির্দেশ দান করা, উপদেশ দান করা ইত্যাদি। উল্লেখিত শব্দটি মূলত বিশেষ কৌশল অর্জনের ওপর জোর দেয়। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ‘শিক্ষা' বলতে বিশেষ জ্ঞান কিংবা বিশেষ কোন কৌশলকে আয়ত্ত করা বুঝায়।
শিক্ষা শব্দটি ইংরেজি Education শব্দের বাংলা রূপায়ন । Education শব্দটি ল্যাটিন Educatum. Educare এবং Educere শব্দ হতে এসেছে। এ শব্দগুলির অর্থ হলো বাহির করা, প্রশিক্ষণ দেয়া, লালন করা, পরিপুষ্টি সাধন করা, পরিচালিত করা ইত্যাদি। Joseph T. Shipley তার Dictionary of Word Origins, এ লিখেছেন Education শব্দটি এসেছে ল্যাটিন Edex, এবং Ducer-duc, শব্দগুলি থেকে । এগুলির শাব্দিক অর্থ হলো, যথাক্রমে বের করা, পথপ্রদর্শন করা। আরেকটু ব্যাপক অর্থে তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া এবং সুপ্তপ্রতিভা বিকশিত করে দেয়া । OXFORD ADVANCED LEARNER'S DICTIONARY তে Education শব্দের অর্থ করা হয়েছে “Knowl- edge, Abilities and the development of character and mental powers that result from such training: Intellectual, moral, physical etc Education.
সক্রেটিসের মতে: মিথ্যার বিনাশ আর সত্যের আবিষ্কার ।
প্লেটো বলেছেন: শরীর ও আত্মার পরিপূর্ণ বিকাশ ও উন্নতির জন্য যা কিছুই প্রয়োজন, তা সবই শিক্ষার উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত ।
এরিস্টটলের মতে: শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো ধর্মীয় অনুশাসনের অনুমোদিত পবিত্র কার্যক্রমের মাধ্যমে সুখ লাভ করা।
জন লকের মতে: শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুস্থ দেহে সুস্থ মন প্রতিপালনের নীতিমালা আয়ত্তকরণ।
কিন্ডারগার্টেন পদ্ধতির উদ্ভাবক ফ্রোবেলের মতে: শিক্ষার উদ্দেশ্য হবে সুন্দর বিশ্বাসযোগ্য পবিত্র জীবনের উপলব্ধি।
জন ডিউই বলেছেন: শিক্ষার উদ্দেশ্য আত্ম উপলব্ধি।
সাহিত্যিক হালি শিক্ষাকে ভেবেছেন ঐশ্বরিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হিসেবে। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষাকে ভেবেছেন পরশ পাথর হিসেবে যা মানুষের মনে জ্বালে আশার আগুন।
অর্থনীতিবিদ এডাম স্মিথ শিক্ষাকে দেখেছেন এমন একটা শক্তিরূপে যা মানুষের অন্তরে নিহিত র্যাসানালিটিকে জাগিয়ে তোলে এবং এ্যানিম্যালিটিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ইকবালের মত ইসলামী চিন্তাবিদদের মতে শিক্ষা হলো সৃষ্টির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য মানুষের অন্তরের শক্তিকে জাগিয়ে তোলা।
মূলত: শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে প্যারাডাইস লস্টের বিখ্যাত কবি মিল্টনের বক্তব্যে; তিনি বলেন Education.
Is The Harmonious development of body, mind and soul. অর্থাৎ শিক্ষা হচ্ছে দেহ, মন এবং আত্মার সমন্বিত উন্নয়নের নাম।
মানুষ প্রভুর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি
নিউরোলজিস্টরা গবেষণা করে বলেছেন, আইনস্টাইনের সংরক্ষিত মগজ সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটা বড়। কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম বাদ দিলে সাধারণভাবে সকল মানুষের প্রতিভাই আল্লাহ প্রদত্তভাবে সমান।।
মানুষের দেহের ওজনের চলিশ ভাগের একভাগ হলো তার মস্তিষ্কের ওজন। আর মৌমাছির দেহের ওজনের একশত সাতচল্লিশ ভাগের একভাগ হলো মস্তিষ্কের ওজন। ক্ষুদ্র এই পতঙ্গগুলি মস্তিষ্ককে পূর্ণভাবে ব্যবহার করে। তাদের বানানো কারুকাজময় মৌচাক আর তাদের শাসনব্যবস্থা দেখলেই তা বুঝা যায়। হাজার মানুষের ভেতর একজনও তার মস্তিষ্কের পূর্ণ ব্যবহার করতে পারে না । আমাদের দেহের ভেতর মাত্র তিন পাউণ্ড ওজনের মস্তিষ্কের গঠন সবচেয়ে জটিল । এমনি কম্পিউটারের চেয়ে হাজার হাজার কোটি গুণ জটিল। ডাক্তার ওয়াল্টারের মতে বৈজ্ঞানিক প্রণালিতে মানুষের মত সমক্ষমতার একটি বৈদ্যুতিক বা এটমিক মস্তিষ্ক তৈরি করতে চাইলে পনের শত কোটি টাকারও বেশি প্রয়োজন হবে। সংখ্যাটিকে অংকে লিখলে দাঁড়ায় ১৫০০, ০০০০০০০, ০০০০০০০ টাকা। অর্থাৎ যে পরিমাণ টাকা দিয়ে বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক প্রায় দশ হাজার কোটি কম্পিউটার কেনা সম্ভব। এই মস্তিষ্ককে চালাতে এক হাজার কোটি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ-এর প্রয়োজন হবে। দৈনিক চালু রাখার জন্যে প্রয়োজন হবে কর্ণফুলীর কাপ্তাইয়ের মতো তিন হাজার আড়াইশত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সামগ্রিক উৎপাদন। এই যান্ত্রিক মস্তিষ্কের আয়তন হবে আঠারোটি এক'শ তলা বিল্ডিংয়ের সমান। আমাদের মস্তিষ্কের সবচেয়ে ওপরের সাদা ঢেউ খেলানো অংশকে কর্টেক্স বলে। স্তরে স্তরে বিন্যস্ত এই কর্টেক্সকে সমান্তরালভাবে সাজালে এর আয়তন হবে দু'হাজার বর্গমাইলেরও বেশি অর্থাৎ প্রায় ব্রুনাই দেশের সমান। চৌদ্দশত কোটি নিরপেক্ষ জীবকোষ দিয়ে কর্টেক্স গঠিত। এ সকল পরস্পর বিচ্ছিন্ন সম্পূর্ণ একক জীবকোষকে নিউরন বলা হয়। এগুলি এতই ক্ষুদ্র যে কয়েকশত একত্রে একটি আলপিনের মাথায় স্থান নিতে পারে। প্রতি সেকেণ্ডেই শত শত হাজার হাজার নিউরন এসে ব্রেইনের প্রাথমিক স্তরে জমা হতে থাকে। এরা একেকটি ইলেক্ট্রোনিক সিগনাল যা শরীরের বিভিন্ন অংশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে এবং মূল নিয়ন্ত্রণের আদেশ অতি দ্রুত হাজার কোটি সেলে ছড়িয়ে দেয়। ব্রেইনের এ সকল প্রতিক্রিয়া অনেক সময় সেকেণ্ডের দশ লক্ষ ভাগের মাত্র একভাগ সময়ে ঘটতে পারে। আমাদের দেহের মেরুদণ্ডের মাধ্যমে নিউরনগুলি সারা শরীরের যন্ত্রপাতিগুলিকে সজীব ও তৎপর রাখে। এগুলির আবার অনেক স্বতন্ত্র বিভাগ রয়েছে যার সংখ্যা প্রায় ২৫০টি। যেমন কোন অংশ শোনার জন্য, কোন অংশ বলার জন্য, কোন অংশ দেখার জন্য আবার কোন অংশ অনুভূতিগুলিকে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল টাওয়ারে ট্রান্সমিট করার জন্য ব্যস্ত থাকে। এতে আবার বসানো হয়েছে একটি স্বয়ংক্রিয় শক্তিশালি ‘মেমোরি সেল’। যার কাজ হলো নিত্য নতুন সংগ্রহগুলিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা এবং প্রয়োজনের সময় তাকে ‘রি ওয়াইন্ড' করে মেমোরিগুলিকে সামনে নিয়ে আসা। এই স্মৃতি সংরক্ষণশালা প্রতি সেকেন্ড ১০টি নতুন বস্তুকে স্থান করে দিতে পারে। পরম আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, পৃথিবীর সর্বকালের সর্বপ্রকারের যাবতীয় তথ্য ও তত্ত্বকে এক জায়গায় একত্র করে যদি এই মেমোরি সেলে রাখা যায় তাতে এর লক্ষ ভাগের একভাগ জায়গাও পূরণ হবে না । সুবহানআল্লাহ! কত শক্তিশালী আমাদের এই মস্তিষ্ক! তবে দুঃখের বিষয়, আমরা এর হাজার ভাগের একভাগও কাজে লাগাই না বা লাগাতে পারি না। শিক্ষার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হবে নিজের সত্তাকে পরিপূর্ণভাবে চেনা এবং তাকে কাজে লাগানো । তাইতো সক্রেটিস বলেছেন ‘নো দাই সেলফ' অর্থাৎ নিজেকে জানো'। আরবি প্রবাদেও বলা হয়েছে ‘মান আরাফা নাফসাহু ফাক্বাদ আরাফা রাব্বাহু' অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিজকে চিনতে পারলো সে তার প্রভুকে চিনতে পারলো।
জ্ঞানীরাই সভ্যতার স্থপতি
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ত্রিশের বিশ্ব মন্দার প্রেক্ষিতে মন্তব্য করেছেন একটা জাতিকে কুসংস্কার ও অজ্ঞানতার অন্ধকার হতে টেনে এনে উন্নয়নের পথে ধাবিত করতে লাগে একশত জ্ঞান সমৃদ্ধ ব্যক্তি যারা দায়িত্ব পালন করবেন জজ, ব্যারিস্টার, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, অর্থনীতিবিদ, হিসাববিদ, প্রকৌশলী, প্রযুক্তিবিদ, প্রশাসক, নির্বাহী ও দক্ষ কর্মী হিসেবে।
চীনারা পরিকল্পনা করে সময়ের প্রেক্ষিতে। এক বছরের পরিকল্পনায় আশু ফল পাওয়ার জন্য তারা চাষ করে ধান। দশ বছরের জন্য পরিকল্পনায় মূল্যবান কিছু পাওয়ার জন্য তারা লাগায় গাছ। একশত বছরের পরিকল্পনায় তারা জোর দেয় মানুষ চাষে। উন্নত দেশগুলো শিক্ষার মাধ্যমে নানাবিধ সম্পদে নিজেদের অলংকৃত করেছে। তারা এখন মঙ্গলে যাচ্ছে, হার্ট ট্র্যান্সপ্লানটেশন করছে। একেবারে উন্নত বিশ্ব নয় আমরা যদি উন্নয়নশীল পূর্ব এশিয়ার দিকেও তাকাই তবুও শিক্ষার গুরুত্বটা হাড়ে হাড়ে বুঝবো।
তিনদশক আগে পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়া একই আয়স্তর থেকে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। কিন্তু বর্তমানে দক্ষিণের তুলনায় পূর্বের মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান ২৭ গুণ এবং মানবউন্নয়ন সূচক ২ গুণ অগ্রসর। মাহবুব উল হকের ‘দক্ষিণ এশিয়ার মানব উন্নয়ন-১৯৯৭' রিপোর্টে উপরিউক্ত বিষয়টির পেছনে ৫টি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। তার ভেতর শিক্ষায় বিনিয়োগ কে সবচাইতে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তারা শিক্ষা খাতে বেশি বিনিয়োগ করেছিল অপরদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় বেশি বিনিয়োগ হয়েছে সামরিক খাতে। পূর্বরা মোট বরাদ্দের ৭০% ব্যয় করতো প্রাথমিক শিক্ষায় কিন্তু আমরা সিংহভাগ ব্যয় করেছি উচ্চতর শিক্ষায় গুটিকয়েক মানুষের পেছনে। পূর্বরা যেমন দঃ কোরিয়ার মাধ্যমিক শিক্ষার ১৮.৬ % কারিগরি শিক্ষা অপরদিকে বাংলাদেশে ০.৭ % অর্থাৎ বাংলাদেশ হতে ২৭ গুণ বেশি।
বড় হতে হলে এ বিশ্বটাকে জয় করতে চাইলে অনেক বেশি পড়ালেখা করতে হবে। বিশ্বে যারাই বড় হয়েছেন তারাই প্রচণ্ড পড়ালেখা করেই বড় হয়েছেন। যিনি দারিদ্রতার কারণে ঘড়ি বিক্রি করে দিয়ে দিনে আধপেট খেয়ে, সারাদিন লাইব্রেরিতে পড়ে থাকতেন আর পৃথিবীকে পরিমাপ করতেন। তিনিই পরবর্তীতে রূপকথাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে জগদ্বিখ্যাত নেপোলিয়ান হয়েছিলেন। আর নেপোলিয়ান যুদ্ধে গেলেও তার সাথে থাকতো একটি চলমান লাইব্রেরি এবং যুদ্ধেক্ষেত্রেও তিনি বই পড়তেন। হেলেন কিলার ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধ; কিন্তু চক্ষুষ্মান অনেক-অনেক লোকের চাইতেও তিনি অধিক সংখ্যক বই পড়েছেন। সাধারণের চাইতে কমপক্ষে একশ গুণ এবং নিজেই লিখেছেন প্রায় এগারোটি গ্রন্থ। আর নোবেল বিজয়ী বার্নার্ডশ, দরিদ্রতার কারণে মাত্র পাঁচ বছর স্কুলে লেখাপড়া করতে পেরেছিলেন তিনি। কিন্তু তিনিই ছিলেন বিশ্বে তার যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। তিনি মাত্র সাত বছর বয়সে শেকসপিয়ার, বুনিয়ান, আলিফ লায়লা, বাইবেল প্রভৃতি অমর গ্রন্থ শেষ করেন আর বারো বছর বয়সেই ডিকেন্স, শেলীর বইগুলি হজম করে ফেলেন তিনি।
সে মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে বই ধার করে এনে পড়তো। তার পড়ার সময় ছিল দিনের কাজের শেষে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো, কামরার মধ্যে চুলিতে একটা নতুন কাঠ জ্বালিয়ে সেই আলোয় সে পড়তো, ঘুমে ঢুলে না পড়া পর্যন্ত। কালক্রমে তিনি হয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের মহান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন।
আমেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট অন্য লোকদের সাথে কথোপকথনের সময়ও ফাঁক দিয়ে বই পড়তেন এবং গ্রাম ভ্রমণের সময় প্রতিদিন প্রায় তিনটি করে বই পড়তেন। ইউরোপ কাঁপানো নেপোলিয়ান বলেছেন, “অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।” ভারতে বৃটিশ শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তক জন মেকলে বলেছেন আরও মজার কথা, “বরং প্রচুর বই নিয়ে গরিব হয়ে চিলেকোঠায় থাকবো, তবু এমন রাজা হতে চাই না যে বই পড়তে ভালোবাসে না” । আর সবচাইতে চরম কথাটি বলেছেন নর্মান মেলর, “আমি চাই বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়”।
একজন মহান জ্ঞানী যখন অসহায়ভাবে রাশিয়ার এক রেলস্টেশনে মারা যান তখন তার ওভারকোটের পকেটে পাওয়া যায় মূল্যবান এক বই ‘দ্যা সেইং অফ প্রোফেট মোহাম্মদ। সেই নোবেল বিজয়ী লিও টলস্টয়কে বলা হয়েছিল জাতীয় উন্নয়নের জন্যে আপনি যুবসমাজের প্রতি কিছু বলুন। তিনি বলেছিলেন আমার তিনটি পরামর্শ আছে:
১. পড়
২. পড়
৩. আর পড়ো
এটি যেন মহান আল্লাহর সেই প্রথম বাণী ‘পড় তোমার সে প্রভুর নামে' এরই প্রতিফলন।
আমাদের উপমহাদেশেও যে সকল ব্যক্তিত্বকে মানুষ সর্বদা স্মরণ করে তারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন মহাজ্ঞানী আর সুউচ্চ ক্যারিয়ারসমৃদ্ধ । আল্লামা ড. ইকবাল মাত্র ত্ৰিশ বছর বয়সে ব্যারিস্টার ও ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মাত্র চব্বিশ বছর বছর বয়সে ব্যারিস্টার হন। ভারতের জনক মহাত্মা গান্ধী, প্রথম প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ব্যারিস্টার ছিলেন। আমাদের নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী তরাও তাদের সময়ের বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও ব্যারিস্টার ছিলেন।
শিক্ষা: সভ্যতার উত্থান পতনের নিয়ামক
মহানবীর আবির্ভাবের প্রায় এক হাজার বৎসর আগে এথেন্সে হেমলক পানে আত্মহত্যা করেন মহামতি সক্রেটিস। অতঃপর এই সহস্র বৎসরে রোমান এবং পারস্য সভ্যতা থিতিয়ে আসে। এই সময়টাকে ইউরোপে অন্ধকারের যুগ বলা হয়।
ভারতবর্ষে কিছুটা জ্ঞানচর্চা থাকলেও আরবে ছিল তখন আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগ। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর ভাষ্য মতে সে সময়ে আরবে মাত্র হাতেগোনা আঠারো জন মানুষ লেখাপড়া জানতেন ।
ইকরা (পড়) শব্দ ধারণ করে নবী হলেন মুহাম্মদ সা. এবং নবুওত পাওয়ার পরই শিক্ষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন একজন উম্মি (অক্ষরের ধারণাহীন) কিন্তু তিনিই হলেন জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ ধারক। রাসূল (সা)-এর ওপর প্রচণ্ড রণাঙ্গনেও নাজিল হতো মহাগ্রন্থ আল-কুরআন; আর তিনি তা যথাযথভাবে আত্মস্থ করতেন। মূলত: কুরআন কেন্দ্রিক জ্ঞানের তিনি এতটাই চর্চা করতেন যে তার শিক্ষক স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাকে বলেছেন “তুমি এত সাধনা করে শেষাবধি নিজকে ধ্বংস করে ফেলো না”। তার প্রেরণায় আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী, আঃ রহমান, তালহা, যোবাযের তাঁরা হলেন এক একজন শ্রেষ্ঠ জ্ঞানতাপস। হযরত আলী (রা)-এর ব্যক্তিগত হাদিস সংকলন ‘সহীফা' সংরক্ষিত থাকতো সর্বদা তার তলোয়ারের খাপের ভেতর। তিনি তো সেই সময়কার একজন শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী ছিলেন। মহানবী জ্ঞানের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন “জ্ঞানার্জন করা প্রতিটি মুসলিম নর এবং নারীর জন্য ফরজ” । এর সময়সীমা সম্পর্কে বলেছেন “তোমরা দোলনা হতে কবর পর্যন্ত জ্ঞানার্জন কর”। এর বিস্তৃতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন “এর জন্য প্রয়োজনে চীন দেশে যাও”। রাসূল (সা) এর সাধনার চিত্রকে পূর্ণরূপে তুলে ধরে প্রখ্যাত প্রাচ্য ভাষাবিদ জার্মান পণ্ডিত ইমানুয়েল ডিউস বলেন “কুরআনের সাহায্যে আরবরা মহান আলেকজান্ডারের জগতের চাইতেও বৃহত্তর জগৎ, রোম সাম্রাজের চাইতেও বৃহত্তর সাম্রাজ্য জয় করে নিয়েছিলেন। কুরআনের সাহায্যে একমাত্র তারাই রাজাধিপতি হয়ে এসে ছিলেন ইউরোপে, যেথায় ভিনিসীয়রা এসেছিল ব্যবসায়ী রূপে, ইহুদিরা এসেছিল পলাতক বা বন্দী রূপে”।
ব্রিফল্ট তার সুপরিচিত ‘দ্য মেকিং অব হিউম্যানিটি ' গ্রন্থে বলেন-‘আমাদের বিজ্ঞানের জন্যে আরবদের কাছে কেবল চমৎকার আবিষ্কার বা যুগান্তকারী সূত্রের জন্যেই ঋণী নই । বিজ্ঞান ব্যাপকভাবে আরবদের সংস্কৃতির কাছে ঋণী । এর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ঋণী ।” বিশ্ববিখ্যাত ঐতিহাসিক টমাস কার্লাইলের ভাষায় “মুহাম্মদ (সা) এর আবির্ভাব জগতের অবস্থা ও চিন্তাস্রোতে এক অভিনব পরিবর্তন সংঘটিত করে। যেন একটি স্ফুলিঙ্গ তমসাচ্ছন্ন বালুকা স্তূপে নিপতিত হল । কিন্তু এই বালুকারাশি বিস্ফোরক বারুদে পরিণত হয়ে দিল্লী হতে গ্রানাডা পর্যন্ত আকাশমণ্ডল প্রদীপ্ত করল।”
পবিত্র কোরআনে নামাজের কথা বলা হয়েছে ৮২ বার অথচ জ্ঞানার্জনের কথা বলা হয়েছে ৯২ বার । আল কোরআনের ৬৬৬৬ টি আয়াতের মধ্যে অন্তত ৭৫০ টি আয়াত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক।
১২৫০ সালে স্পেনের টলেডোতে আজকের সভ্য ইউরোপের শিক্ষক মুসলমানেরা প্রথম শিক্ষাকেন্দ্ৰ School of Oriental Studies স্থাপন করেন। কর্ডোভাতে পৃথিবীর প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মুসলমানরা স্থাপন করেন। যেখানে সব সময়ে ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় দশ হাজার ছাত্র অধ্যয়ন করতো। যার ব্যাপারে যোশেফ হেলের মন্তব্য হলো:
Cordova shone like lighthouse on the darkness of Europe. আমরা সেই সময়ের কথা বলছি যখন ইউরোপে খ্রিস্টানদের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটি ছিল রানী ইসাবেলার অধীনে যাতে বইয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০১টি। অপরদিকে তৎকালীন ফাতেমীয় সাম্রাজ্যের রাজধানী আলেকজান্ড্রিয়াতে মুসলমানদের পাঠাগারে জমা ছিল ১০ লক্ষ বই।
ঠিক যে সময় অসভ্য ইউরোপে মুসলমানদেরই আবিষ্কার পৃথিবী গোল বলার অপরাধে মিঃ ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়, গ্যালিলিওকে বিজ্ঞানের প্রচারের জন্য কারাগারে আটক করা হয় অবশেষে অন্ধ, বধির হয়ে তিনি সেখানেই মারা যান। কাগজ, ঘড়ি, বারুদ, মানচিত্র, ইউরোপ থেকে ভারতের রাস্তা এমনকি আমেরিকার আবিষ্কর্তা মুসলমানেরা। এই জ্ঞানের শক্তিতেই একদিন মুসলমানরা সারা পৃথিবীকে শাসন করেছে প্রায় হাজার বছর।
দুর্ভাগ্য— আজকে তারাই বিশ্বে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ জাতি। কারণ এক সময় পৃথিবীর শিক্ষক হলেও এখন তারাই সবচেয়ে কম পড়ালেখা করে। ইকরা অর্থাৎ ‘পড়’ দিয়ে ইসলামের যাত্রা আরম্ভ হলো। রাসূল (সা) জ্ঞানকে আখ্যায়িত করলেন শত্রু মহলে ঢাল এবং মিত্র মহলে অলংকার হিসাবে। অথচ আন্তর্জাতিক এক ম্যাগাজিনের ভাষ্যমতে এখন জাতি হিসেবে বিশ্বে মুসলমানদের শিক্ষার হার ১৯%, হিন্দুদের ২৪%, বুদ্ধিস্টদের ৪৯%, খ্রিস্টানদের ৯৮% এবং ইহুদিদের ৯৯%। বুঝা গেল কম শিক্ষিত হওয়ার কারণে মুসলমানরা মার খাচ্ছে। অথচ রাসূল (সা) বলেছেন-সবচাইতে মূল্যবান কথাটি, “জ্ঞান হচ্ছে মুসলিমদের হারানো সম্পদ সুতরাং যেখানে তা পাও কুড়িয়ে নাও”। আল্লাহপাক মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, তোমরা সর্বোত্তম জাতি মানবতার কল্যাণের জন্য তোমাদের সৃষ্টি করা হয়েছে-অথচ আজ পৃথিবীর যে দিকেই তাকাই দেখতে পাই সারা পৃথিবীতে মুসলমানেরা আজকে চরম পশ্চাৎপদতা, বঞ্চনা আর সর্বগ্রাসী নির্যাতনের শিকার। তাহলে কি আল্লাহর ঘোষণা কখনও মিথ্যা হতে পারে? না বরং আসল সত্য হলো, যাদের উদ্দেশ্যে এই ঘোষণা দিয়েছেন তারা সেই সত্যিকার মুসলমান হতে পারেনি। এক্ষেত্রে আল্লাহর প্রথম নির্দেশ জ্ঞানার্জন না করা প্রথম ও প্রধান কারণ।
শিক্ষা: সাম্রাজ্যবাদীদের হাতিয়ার, মজলুমের বর্ম
আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের জন্মদিন ১৪৯২ সালের ১০ অক্টোবর অর্থাৎ কলম্বাস যেদিন বাহামা দ্বীপে অবতরণ করেন। না কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেননি। তিনি করেছিলেন আক্রমণ। কলম্বাস আবিষ্কার করেছিলেন: আদিবাসীদের সম্পদ আছে, কিন্তু মানবপ্রযুক্তিতে ওরা দুর্বল। লুণ্ঠনের চাইতে লাভজনক আর কিছু নেই। লুণ্ঠন বজায় রাখতে চাইলে মানব প্রযুক্তিতে শ্রেষ্ঠত্ব প্রয়োজন। আর তাই দরকার উচ্চতর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। কলম্বাসের উত্তরকালে যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদীরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি তথা শিক্ষাকে এ কাজেই ব্যবহার করেছে।
বসনীয়ার সাবেক দার্শনিক প্রেসিডেন্ট মরুম আলীয়া আলী ইজেতবিগোভিচ, বলেন “আধুনিক শিক্ষা মানুষকে অধিকতর ভাল, অধিকতর স্বাধীন বা অধিকতর মানবিক করে না। পরিবর্তে শিক্ষা মানুষকে অধিকতর দক্ষ, অধিকতর সমর্থ ও সমাজের জন্যে অধিকতর উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পশ্চাৎপদ মানুষের চেয়ে শিক্ষিত মানুষেরা অকল্যাণকর কাজে বেশি পটু। সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস অধিকতর সভ্য ও শিক্ষিত মানুষ কর্তৃক অল্প শিক্ষিত ও অনগ্রসর মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায়, অযৌক্তিক ও বশ্যতামূলক আগ্রাসনের ইতিহাস। শিক্ষার উচ্চ স্তর সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসী তৎপরতাকে মসৃণ করা জন্যেই সব রকমের সহায়তা করেছে।”
ইউনেস্কো প্রকাশিত 'General History of Africa তে আমরা কথিত আদিম আফ্রিকীয় মানুষের সাংস্কৃতি সম্পর্কে আগ্রহোদ্দীপক চিত্র পাই । সে সময় এ সকল রাজ্যে বিদেশী সাদা কিংবা কালো মানুষ গেলে তারা আগন্তকদের আন্তরিক আতিথেয়েতা করতো এবং স্থানীয় অধিবাসীদের মতো সকল রকম সুযোগ সুবিধাও তাদের দেওয়া হতো । অথচ এই একই সময়ে সভ্যতাগর্বী প্রাচীন গ্রিস কিংবা রোমে বিদেশী আগন্তকদের দাস হিসাবে গণ্য করা হতো।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সুসভ্য স্প্যানিশরা কি নির্মম ও নির্লজ্জভাবে মায়া ও এ্যাজটেক জাতি এবং তাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে। সভ্য ও সাদা চামরার লোকেরাই কি আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান উপজাতিদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা করেনি? তিনশো বছর ধরে ইউরোপ-মার্কিন সভ্যতার ধারকেরা যে তের থেকে পনের মিলিয়ন (আসল সংখ্যা কোনদিন জানা যাবে কি?) কালো নিরীহ মানুষকে নিয়ে দাস ব্যবসা চালিয়েছে তাকি ইতিহাসে কখনও মোছা যাবে? ইন্ডিয়ানদের ওপর এই নির্যাতনের কাহিনী সম্বলিত বিশ্ববিখ্যাত উপন্যাস ‘রুটস' এর লেখিকা আলেক্স হ্যালি কে কিছু বাহবা দিয়েই কি এ পাপমোচন হবে?
সাম্রাজ্যবাদীদের এই হিঃস্রতা তাদের হঠাৎ কর্ম নয় বরং এটি তাদের দার্শনিকদেরই শিক্ষা যেমন নিটশে বলেছেন; বিবেক, সহানুভূতি ক্ষমা এই সব মানবিক দৈত্যদের হাত হতে মুক্ত হও। দুর্বলকে নিশ্চিহ্ন করে তাদের লাশের ওপর দিয়ে এগিয়ে যাও সামনের দিকে। তার নিকট খ্রিষ্টবাদ, বিশেষত তার নীতি ভাক্ষনা উদ্দীপনাময় মানবজাতির দেহে প্রবিষ্ট নিকৃষ্ট বিষ।”
নিটশের চিন্তার ধারকেরা সাম্রাজ্যবাদী রূপে বিশ্বের দিকে দিকে তাদের হিংস্র থাবা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দুর্বলের লাশের সিঁড়ি বেয়ে তাদের সভ্যতার প্রাসাদ গড়তে। আর এ ক্ষেত্রে শিক্ষা ছিল তাদের অন্যতম সফল হাতিয়ার।
এ ক্ষেত্রে আমাদের উপমহাদেশ একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘ঐতিহাসিক ইবনে বতুতাসহ বিভিন্ন পরিব্রাজকরা আমাদের দেশ সম্পর্কে বলেছেন “যেন সপ্তস্বর্গ এই রাজ্যে পৃথিবীর স্বর্ণরাজি ছড়িয়ে রেখেছে।” ষোড়শ শতকে বার্নিয়ার আরো লিখেছেন, ‘বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশ' কিন্তু হায়! দীর্ঘ প্রায় তিনশত বছর যাবৎ মগ, ফরাসি, ব্রিটিশবেনিয়া, পশ্চিমবঙ্গের ব্রাহ্মণ্যবাদী জমিদার শ্রেণী সর্বোপরি আমাদের দেশেরই কিছু মানুষের জঘন্য লুটপাট সেই সোনার বাংলাকে শ্মশান বাংলায় রূপান্তরিত করেছে। আর এ ক্ষেত্রে তার শিক্ষাকেই প্রধান অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছে।
বস্তুবাদী শিক্ষা : সভ্যতার স্থূলদেহে ক্যান্সার
বস্তুবাদী শিক্ষা মানুষকে আরো দক্ষ আরো কৌশলী করে । কিন্তু ব্যক্তি মানুষ, তার পরিবার এমনকি রাষ্ট্রে শিক্ষা কতটুকু উন্নয়ন করে, কোন দিকে করে? কোনদিকে নয়? প্রশ্নটি আজকে শিক্ষার মতোই মৌলিক হিসেবে প্রতিভাত হচ্ছে । বর্তমান পৃথিবীর শাসকরা বস্তুগত ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা উন্নয়নের প্রতি নজর দিলেও মন ও আত্মার উন্নয়ন এবং এ শিক্ষার দিকে কোনই নজর দেয়নি। যার ফলে সভ্যতার স্থূলদেহে সৃষ্টি হয়েছে মারত্মক ক্যান্সার ।
আমেরিকার হাইড্রোজেন বোমার স্রষ্টা বৈজ্ঞানিক অপেনহেইমারের আণবিক বোমার ধ্বংস ক্ষমতা দেখে সকল প্রকার আণবিক গবেষণা বন্ধ করে দিয়ে প্রাচ্য দর্শন অধ্যয়ন শুরু করেন । তার মতে প্রযুক্তি ও বস্তুগত উন্নয়নের প্রেক্ষিতে মানবজাতি গত চার'শ বছরে যা করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে গত চল্লিশ বছরে। ১৯০০ সাল থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত মানুষে মানুষে মনোদূরত্ব বেড়ছে ১০২৬-১০৪৪, তাপমাত্রা বেড়েছে ১০৫-১০১১ চাপ বেড়েছে ১০১০-১০১৬।
১৯৬৫ সালে আমেরিকানরা শুধু ছুটি কাটানো বাবদ খরচ করে ৩০ বিলিয়ন ডলার। সে দেশে ব্যক্তিগত ব্যবহার্যের দুই-তৃতীয়াংশ বিলাসদ্রব্য। ধনী দেশগুলো বছরে শুধু কসমেটিকস- এ খরচ করে ১৫ বিলিয়ন ডলার। এ সমস্ত দেশে জীবনযাত্রার মান ১৮০০ সালে যা ছিল তার চেয়ে পাঁচগুণ বেশি উন্নত এখন। আগামী ৬০ বছরে আজ যা আছে তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি উন্নত হবে। কিন্তু আমরা প্রশ্ন করতে পারি, আগামী ৬০ বছরে মানব জীবন পাঁচগুণ বেশি সুখী ও মানবিকতাপূর্ণ হবে? স্বতঃসিদ্ধরূপেই উত্তর আসবে না। বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত অপরাধ বিজ্ঞানীদের সপ্তম আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে (১৯৭৩, সেপ্টেম্বর) সর্বসম্মতিক্রমে স্বীকার করা হয় যে, বর্তমান সময় অপরাধের বিশ্বজনীন আগ্রাসন দ্বারা আক্রান্ত। মার্কিন অপরাধ বিজ্ঞানীরা হতাশভাবে বলেন, আমাদের গ্রহ এক স্খলনের সমুদ্র' অর্থাৎ কম বেশি সকলেই অপরাধপ্রবণ এবং এখান থেকে মুক্তির কোন পথ দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘ মহাসচিবের এক রিপোর্টে বলা হয় বস্তুগত উন্নতি সত্ত্বেও মানব জীবন কখনোই এতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেনি। বিভিন্ন প্রকৃতির অপরাধ যেমন চুরি, প্রতারণা, দুর্নীতি, ডাকাতি, আধুনিক জীবন ও প্রগতির প্রতিনিধিত্ব করছে।
বিগত পনের বছরে যত আমেরিকান নাগরিক আগ্নেয়াস্ত্রের দ্বারা নিহত হয়েছে, তাদের সংখ্যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত আমেরিকান সৈন্যদের মোট সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি । পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৬৫ সালে পাঁচ মিলিয়ন অপরাধকর্ম সংঘটিত হয়। ১৯৯৩ সালে অপরাধের সংখ্যা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৪ কোটি ৪০ লাখে দাঁড়ায়। সেখানে ভীতিকর অপরাধকর্ম বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের চেয়ে তিন গুণ বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামীতে আমেরিকায় ১০ বছরের কমবয়স্ক ঘাতক শিশুর সংখ্যা ১ লক্ষে দাঁড়াতে পারে । বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমিক স্কুলগুলোর শতকরা ৩১ ভাগ ছাত্রছাত্রী অস্ত্রসহ ক্লাসে আসে। এ প্রেক্ষিতে অনেক স্কুলে মেটালডিটেক্টর যন্ত্র বসানো হয়েছে। শুধু ১৯৮৬ সালেই আমেরিকার স্কুল সমূহে তিন লাখ ৬০ হাজার সহিংস ঘটনা সংঘটিত হয়। ঐ বছর স্কুল ছাত্র- ছাত্রীদের নিকট থেকে ৭০ হাজার অস্ত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়।
সে দেশে প্রতি সেকেন্ডে ১২টি অপরাধ প্রতি ২০ মিনিটে একটি খুন, প্রতি ৬ মিনিটে একটি ধর্ষণ, প্রতি ৩ মিনিটে একটি ডাকাতি ও প্রতি মিনিটে একটি করে গাড়ি চুরির ঘটনা ঘটে।
সমগ্র ইউরোপের মতোই বরং তার চাইতে বেশি যৌন অনাচার গোটা আমেরিকান জাতিকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমেরিকার কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণীদের শতকরা ৮২ ভাগই ২০ বছর বয়স হবার পূর্বে যৌন অভিজ্ঞতা অর্জন করে । যুক্তরাষ্ট্রে বছরে প্রায় ১৬ লাখ গর্ভপাত ঘটানো হয়। এর বেশিরভাগই কম বয়স্কা অবিবাহিতা মেয়ে। এর পরও শুধু ১৯৯২ সালেই অবিবাহিতা মায়েরা ৩ লাখ ১১ হাজার শিশুর জন্ম দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর মোট যত শিশু জন্ম নেয় তার মধ্যে শতকরা ৪১ ভাগই জারজ সন্তান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিবাহিতা নারীদের শতকরা ৪০ জন এবং বিবাহিত পুরুষদের শতকরা ৬৫ জন স্বামী বা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও ব্যভিচারে লিপ্ত থাকে। প্রতি একশ বিবাহের মধ্যে ৫৫ টি ভেঙ্গে যায়। রয়টারের মতে মার্কিন সিনেটের বিচারবিভাগ সংক্রান্ত কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী আমেরিকায় প্রতি ঘন্টায় ষোল জন নারী ধর্ষণের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হয়। অন্যদিকে প্রতি ছয় মিনিটে একজন মার্কিন নারী ধর্ষিতা হয়। নিউইয়র্কের সর্বোচ্চ বিচারালয় থেকে সমকামীদের পারস্পরিক বিবাহকে আইনসম্মত হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ওয়াশিংটন পোস্ট-এর এক রিপোর্টে বলা হয়, রোমান ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের মধ্যকার সন্ন্যাসীদের শতকরা পঞ্চাশ ভাগই সমকামী। শুধু তাই নয়, সমকামী সন্ন্যাসীরা তাদের সমকামিতাকে বৈধ ঘোষণার জন্যে গির্জার নিকট দাবি জানিয়েছে।
উপরিউক্ত অনাচারের ফলে এইডস রোগে আক্রান্ত হয়ে ৩১শে ডিসেম্বর ১৯৯২ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৯০ জন প্রাণ হারায়। বর্তমানে আমেরিকায় এইডস রোগের ভাইরাস বহন করছে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ। কিন্তু ওয়াশিংটন পোস্ট-এর ভাষ্যমতে সবচেয়ে ভয়াবহ হলো এদের চিকিৎসা দেবে যারা সেই আমেরিকায় সাত হাজার চিকিৎসকও এইডসের ভাইরাস বহন করছে। রুশ মনস্তাত্ত্বিক হোজকভের গবেষণায় দেখা যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মাদকাসক্তি তুমুলভাবে অনেক বেড়েছে, বিশেষত উন্নত দেশগুলোতে। মাদকদ্রব্য সেবনজনিত মৃত্যুর হার বার্লিনে ১০০০০০ জনে ৪৪.৩ জন, ফ্রান্সে ৩৫ জন, অস্ট্রিয়ায় ৩০ জন। মাদকদ্রব্যে সর্বোচ্চ হারে কর আরোপ করেও অবস্থা তথৈবচ। রয়টারের ভাষ্যমতে, জর্জবুশের দুই কিশোরী কন্যাসহ সেখানে ১৮ বছরের কমবয়সী তরুণ-তরুণীদের শতকরা ৩৫ ভাগ মাদকাসক্ত। এর বিচার কে করবে আমেরিকার আইজীবীদের প্রতি পাঁচ জনের একজনই মাদকদ্রব্যে আসক্ত । আগে মাদকাসক্তিকে দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতার সাথে সম্পর্কিত ভাবা হত, সেক্ষেত্রে সমাধানের সম্ভাবনাও ছিল। কিন্তু উন্নত দেশে মাদকাসক্তি কেন? প্রাচুর্যের সন্তানেরা কিসের থেকে পলায়ন করতে চায়?
পর্নোগ্রাফির আগ্রাসনও সুস্পষ্ট। সকল ফরাসি প্রেক্ষাগৃহের অর্ধেক জুড়েই চলে পর্নো ছায়াছবি। প্যারিসেই ২৫০টি সিনেমা হল শুধু পর্নো চলচ্চিত্র প্রদর্শন করে। সেই সাথে যোগ হয়েছে জুয়া । বৃহত্তম জুয়া নগরীগুলো সভ্যতম অঞ্চলে অবস্থিত, দোভিলে, মন্টে কারলো, ম্যাকাও, লাস ভেগাস। আটলান্টিক সিটির বিশাল নৃত্যশালার একটি ঘরে ৬০০০ জুয়াড়ির ধারণ ক্ষমতা রয়েছে।
মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে মানুষ তার জীবনের সার্বিক স্বাচ্ছন্দ্য ও উৎকর্ষের মধ্যেই অতৃপ্তি দ্বারা আক্রান্ত হয় বেশি-বলছেন একজন মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক । যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি এক হাজারে চারজন জন মানসিক হাসপাতালের বাসিন্দা, নিউইয়র্ক শহরে এই সংখ্যা হাজারে ৫.৫ জন। হলিউডে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানসিক চিকিৎসকের সমাগম। আমেরিকার গণস্বাস্থ্য সার্ভিসের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রত্যেক পাঁচজন মার্কিনির একজন মানসিক ও দৈহিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন।
ভোগবাদ ও উচ্ছৃঙ্খলতার চূড়ান্ত পরিণতি সুখকর নয়; এর পরিণতি জীবন সম্পর্কে হতাশা । তাই আত্মহত্যার হার স্বাভাবিক মৃত্যুর হারকে ছাড়িয়ে গেছে । ১৯৯৫ সালে আমেরিকায় স্বাভাবিক মৃত্যু বরণকারীদের সংখ্যা ছিল ২২ হাজার ৫৫২ জন সেখানে প্রতিদিন ৮৫ হারে বছরে ৩১ হাজার লোক আত্মহত্যা করে। এছাড়া প্রতিদিন আরো ২ হাজার অর্থাৎ বছরে ৭ লাখ ৩০ হাজার ব্যক্তি আত্মহত্যার চেষ্টা করে । এখন যুক্তরাষ্ট্রে শত শত নিরাপদে আত্মহত্যার ক্লিনিক চলছে আর এটি একটি শিল্প হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, যে সমস্ত দেশে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা সর্বাধিক তাদের তালিকায় প্রথম আটটি দেশ হল জার্মানি, অস্ট্রিয়া, কানাডা, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, সুইডেন ও সুইজারল্যান্ড। এ সমস্ত দেশে হৃদরোগ ও ক্যান্সারের পরেই আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর স্থান (১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়স্কদের মধ্যে) একই সংস্থার ৭০ সালের রিপোর্টে এ ব্যাপারগুলোকে শিল্পায়ন, নগরায়ন ও পারিবারিক ভাঙ্গনের সাথে যুগপৎ হিসেব ধরা হয়েছে। এক্ষত্রে উন্নয়ন ও শিক্ষাকেও যুক্ত করা যায়। যুগোস্লাভিয়ার অতি উন্নত অঞ্চল সোভেনিয়াতে যেখানে সাক্ষরতার হার ৯৮% প্রতি ১০০০০ জনে আত্মহত্যার সংখ্যা ২৫.৮ জন কিন্তু অনুন্নত কসোভোতে (যেখানে সাক্ষরতার হার ৫৬%) মাত্র ৩.৪% (অনুপাত ৭:১)। ড. এ্যান্থনি বেইলের গবেষণা মতে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রদের মধ্য আত্মহত্যার সংখ্যা তাদের সমবয়স্ক অন্যদের তুলনায় ছয়গুণ বেশি। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা তাদের বয়সী অন্যদের তুলনায় দশ গুণ বেশি। অথচ এখানে অধ্যয়নকারী ছাত্রছাত্রীরা ধনাঢ্য পরিবার থেকে আগত নয়ত সরকারি বৃত্তিধারী।
১৯৬৮ সালের নোবেল সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত কাওয়াবাতা ১৯৭১ সালে আত্মহত্যা করেন। এর দু'বছর আগে ১৯৬৯ সালে আরেকজন জাপানি ঔপন্যাসিক তুর্কিয়ো মিশিমা একইভাবে জীবনাবসান ঘটান। ১৮৯৫ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত অন্তত তের জন জাপানি ঔপন্যাসিক ও লেখক আত্মহত্যা করেছেন। জাপানি সংস্কৃতির এই অবিরাম ট্রাজেডি হল জাপানের প্রথাসিদ্ধ সংস্কৃতিতে পশ্চিমা সভ্যতা ও বস্তুবাদী ভাবধারার অনুপ্রবেশের পরোক্ষ ফল। মৃতুর এক বছর আগে কাওয়াবাতা লেখেন মানুষ এক কংক্রিটের দেয়াল দ্বারা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন, সে দেয়াল ভালবাসার সকল সঞ্চালনকে বাধাগ্রস্ত করে। প্রগতির নামে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছে প্রকৃতির। তুষার রাজ্য নামক উপন্যাসে কাওয়াবাতা মানুষের নিঃসঙ্গতা ও বিচ্ছিন্নতা কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে তুলে ধরেছেন। আন্দ্রে মার্লো ঊনবিংশ শতকের আশাবাদের চূড়ান্ত ব্যর্থতা দেখে বিস্ময়াভিভূত হয়েছেন ; ইউরোপ ধ্বংসাক্রান্ত এবং রক্ত দ্বারা কলঙ্কিত মানুষ তৈরি করতে চেয়েছিল, ইউরোপ তা করেছেও।
এই প্রেক্ষাপটে, আমেরিকার এককালের খ্যাতিমান টিভি বিশ্লেষক জিমি সোয়াগার্ট তার বিখ্যাত বই ‘হোমোসেক্সুয়ালিটি'তে আর্তনাদ করে বলেছেন আমেরিকা বিধাতা অবশ্যই তোমার বিচার করবেন (অর্থাৎ ধ্বংস করবেন); আর তিনি যদি তোমার বিচার না করেন, তাহলে সমকামিতা (ও অন্যান্য নৈতিক অপরাধে) এর কলুষতায় অস্বাভাবিকভাবে লালসা চরিতার্থ করার অপরাধে সডোম ও ঘোমরার জনপদের (আদ, সামুদ আর লুত সম্প্রদায়) অধিবাসীদের কেন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল; সেজন্য স্বয়ং বিধাতাকেই একদিন ক্ষমা চাইতে হবে।”
সত্যিকার প্রগতি : শিক্ষার সাথে নৈতিকশিক্ষার সমন্বয়
বস্তুবাদী শিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন বসনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মরুম আলীয়া আলী ইজেতবিগোভিচা, তিনি বলেছেন-সভ্যতা মানুষকে শিক্ষিত করে, সংস্কৃতি (ধর্ম) মানুষকে আলোকিত করে। একটির প্রয়োজন জ্ঞানার্জন অপরটির প্রয়োজন ধ্যান বা প্রার্থনা।
ধ্যান নিজেকে জানার এবং পৃথিবীতে নিজের স্থানকে বুঝে নেয়ার অন্তর্নিষ্ঠ প্ৰচেষ্টা যা জ্ঞানার্জন, শিক্ষা কিংবা বাস্তব উপাত্তসমূহ সংগ্রহ প্রচেষ্টার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ধ্যানে নিজের ওপর আধিপত্য করা যায়, বিজ্ঞান সাহায্য করে প্রকৃতির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করতে। আমাদের স্কুল-কলেজের শিক্ষা আমাদের সভ্যতাকে এগিয়ে নেয় সংস্কৃতি (বা নৈতিকতা) কে নয়। আজকের দিনে মানুষ শেখে অতীতে মানুষ ধ্যানমগ্ন হত। কিংবদন্তি বলে বোধিপ্রাপ্ত হওয়ার আগে মহামতি বুদ্ধ তিন দিন তিন রাত্রি নদীর ধারে ধ্যানমগ্ন হয়ে স্থানুর মত দাঁড়িয়ে ছিলেন, সময়চেতনা বিস্তৃত হয়ে। জেনোফেন সক্রেটিস সম্পর্কে লিপিবদ্ধ করেছেন “একদিন সকালে সক্রেটিস একটি জটিল সমস্যা নিয়ে চিন্তা করছিলেন যার সহজ সুরাহা হচ্ছিল না, দুপুর গড়িয়ে গেল, তিনি ঠাঁই দাঁড়িয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। তখন কেউ কেউ ঘটনাস্থলের অদূরে তাদের মাদুর এনে অবস্থান নেয় যাতে তার গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। সক্রেটিস দিনাবসানের পর সারা রাত্রিও একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন, অতঃপর পরের দিন সূর্যোদয়ের পর তার ধ্যান ভঙ্গ হয় ”। সত্যিকারের জ্ঞানার্জনের জন্য আমরা লক্ষ্য করি মূসা (আ) চলিশ দিবারাত তুর পাহাড়ে, ইসা (আ) গ্যালিলিতে আর যুবক মুহাম্মদ (সা) হেরা গুহায় পনের বছর ধ্যানমগ্ন ছিলেন । আর এটাই সত্য যে তাদের শিক্ষাই পৃথিবীকে সবচাইতে বেশি আলোড়িত করেছে এবং তাদের পেশকৃত নৈতিকজ্ঞানে সমৃদ্ধ কিতাবই পৃথিবীতে সর্বাধিক পঠিত এবং সর্বাধিক বিক্রীত । নৈতিকশিক্ষা ও বস্তুবাদী শিক্ষার তুলনা চলে পৃথিবী বিখ্যাত দুই ব্যক্তির মাধ্যমে।
টলস্টয় তার সারা জীবন অতিবাহিত করেন মানুষ ও মানুষের নিয়তি বিষয়ে চিন্তা করে, অপরদিকে ইউরোপীয় সভ্যতার প্রবাদপুরুষ গ্যালিলিও সারা জীবন নিজের চিন্তাকে বেঁধে রাখেন একটি বস্তুর পতনজনিত সমস্যার সাথে।
আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক প্লেটো, এরিস্টটল তাঁদের দর্শন চিন্তায় সত্যিকারের সৎ ও নিষ্ঠাবান নাগরিক তৈরি করতে নৈতিক শিক্ষার প্রয়োজন বলেছেন। আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আগে আদর্শলিপি দেখে হাতের লেখা অভ্যেস করতে হতো আর তাতে লেখা ছিল ‘সর্বদা সত্য কথা বলিবে“ চুরি করা মহা পাপ, গুরুজনে সম্মান করিবে' অহঙ্কারই পতনের মূল' ইত্যাদি। টলস্টয়ের ‘একজন মানুষের কতটুকু জমির প্রয়োজন' এই গল্পটি, যার নীতিকথা হলো “লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু । এইভাবে শিক্ষাদানে সক্ষম হলে শিশু-কিশোরদের মনে নীতিবোধ জাগ্রত হবে। আমাদের একটা বড় সঙ্কট হচ্ছে আমরা হঠাৎ খুব জোরে জাম্প দিতে চাই। এই জাম্প দিতে যেয়ে আমাদের কালচারাল, আইডেন্টিটি, মোরালিটি এবং স্পিরিচুয়াল ক্রাইসিস হয়ে যায়। এর কারণ কী? এর কারণ আমাদের নীতিহীনতা। তৎকালীন শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য ছিল আত্মার উন্নয়ন। যার জন্য সাধনা, চিন্তা ও আত্মসংযমের প্রয়োজন হতো।
বস্তুতপক্ষে এডুকেশন শব্দটির প্রতি অক্ষরে কাঙ্খিত শিক্ষার স্বরূপ তথা নৈতিকতারই বর্ণচ্ছটা ফুটে ওঠে। সকল কাজে নিরপেক্ষতা ও ন্যায়পরায়ণতা বা ইকুইটি(ই) দেশ জনগণ ও পরিারের জন্য সদা কর্তব্যপরায়ণ বা ডিইটিফুলনেস (ডি) সত্য ও সুন্দরের জন্য ঐক্যবদ্ধ বা ইউনিটি (ইউ), সমস্যার সমাধানের জন্য নতুন পথ উদ্ভাবন বা সার্চ (সি), জাতীয় সম্পদের সম্যক ব্যবহারের দায়বদ্ধতা বা একাউন্টিবেলিটি (এ), আচার-ব্যবহার ও সততা অর্থাৎ ট্রান্সপারেন্সি(টি), নবদিগন্তের উন্মোচন বা ইনভেস্টিগেশন (আই) জাতির প্রতি কর্তব্যবোধ ও আনুগত্যপরায়ণ বা ওবেডিয়েন্ট (ও) এবং মহৎ কাজের প্রতি আসক্তি বা এনথেসিয়াস (এন)।
নেপোলিয়ান যখন বললেন আমাকে ভাল মা দাও, আমি তোমাদিগকে ভাল জাতি দেব। তখন কিন্তু তিনি খুবই শিক্ষিত মায়ের কথা বলেননি বরং বলেছেন চরিত্রবতী, ধৈর্যশীলা ও ন্যায়বান এক মায়ের কথা। আধুনিক অর্থশাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথ ছিলেন একজন দার্শনিক। তার থিওরি অব মোরাল সেন্টিমেন্টস একটি অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ অবদান হিসেবে দর্শনশাস্ত্রে স্বীকৃত। ২০০১ সালের নোবেল পুরস্কারও কিন্ত অর্থনীতির নৈতিকতা বিষয়েই দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ সকল ক্ষেত্রেই নৈতিকতার গুরুত্ব।
বস্তুবাদী শিক্ষা সদা পরিবর্তনশীল কিন্তু নৈতিক শিক্ষা শাশ্বত, কিভাবে সৎ জীবন যাপন করা যায় সে প্রশ্নের উত্তরে প্রাচীন গ্রীসের সাত সাধুর এক সাধু থেলেস (জন্ম-৬২৪ খৃঃ পূর্ব) বলেছিলেন যে কাজের জন্যে আমরা অন্যকে তিরস্কার করি, নিজেরা সেটা না করা। প্রাচীন রোমের সিসেরো বলেন, অন্যের যা কিছুকে তুমি সমালোচনা কর সেটা হতে দূরে থাকো। সমগ্র তাওরাত এই নীতির সাথে সম্পৃক্ত। মহামতি বুদ্ধ ভারতে এবং পিথাগোরাসের সমসাময়িক কনফুসিয়াসও একই শিক্ষা প্রচার করেন চীনে। আমি নিজে যা করতে চাইনে তা অন্যের জন্যেও করি না; একই নীতি যিশুখৃষ্ট প্রকাশ করেছেন তার বিখ্যাত উক্তিতে ; Do unto others as you would have them unto you, ৬শত বছর পর আরবের মরুভূমিতে মুহাম্মদ (সা) একই কথা বলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় সার্বজনীন নীতির আঙ্গিকগত বৈচিত্র্য থাকতে পারে কিন্তু কোন মৌলিক পরিবর্তন নেই।
প্রথাগত শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে তেমন অগ্রসর না হয়েও রাসূল (সা) বিশ্ব ইতিহাসের সবচেয়ে সফল বিপ্লব করেছেন। কারণ তাঁর শত ব্যস্ততার ভেতরও প্রতিদিন কমপক্ষে ছয় থেকে আট ঘন্টা তিনি আলাহর প্রার্থনায় কাটাতেন। এমনকি বদর যুদ্ধের সেই কঠিন মুহূর্তে কাফেরদের তিন ভাগের এক ভাগ নিরস্ত্র প্রায় মুসলমানদের যুদ্ধক্ষেত্রে রেখে তিনি আল্লাহর কাছে প্রার্থনায় বসে গেলেন। আর আল্লাহও দিলেন তাকে চূড়ান্ত বিজয়। নামাজরত অবস্থায় পায়ে বিদ্ধ তীর টেনে বের করার পরও টের পাননি যিনি, তিনিই হয়েছিলেন কাফিরদের ত্রাস শেরে খোদা হযরত আলী হায়দার। আর তাইতো খেলাফতের যুগে চীনের এক গোয়েন্দা চীনসম্রাটের কাছে মুসলমানদের ব্যাপারে রিপোর্ট পেশ করেছিল- “এদের রাত কাটে জায়নামাজে কেঁদে-কেটে, আর দিনের বেলার আকাশ অন্ধকার হয়ে যায় এদের ঘোড়ার খুরের দাপটে, উড়ন্ত ধুলায়; সুতরাং এদের কেউ পরাস্ত করতে পারবে না।” ঠিক এমনি যুদ্ধের বিজয়ের মতোই আত্মগঠনের সাফল্যের জন্যেও দরকার আল্লাহর কাছে অবিরত প্রার্থনা। যেমন আল্লাহই শিখিয়েছেন দোয়া “হে প্রভু আপনি আমাদের জ্ঞান বাড়িয়ে দিন।” আধুনিক বিজ্ঞানীরাও ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন। বিজ্ঞানীদের ভেতর সবচেয়ে বড় নোবেল পাওয়া বিজ্ঞানী অ্যালেঙ্গি কমরেখ পৃথিবীর সর্বাধিক প্রচারিত ‘রিডার্স ডাইজেস্ট' পত্রিকায় এক প্রবন্ধে লেখেন, “প্রার্থনা একজন মানুষকে সবচেয়ে বড় শক্তি দান করতে পারে। এই শক্তি কাল্পনিক শক্তি নয় মাধ্যাকর্ষণের মতোই তা অত্যন্ত বাস্তব।
একজন ডাক্তার হিসাবে আমার অভিজ্ঞতা হল- সমস্ত ওষুধ ও চিকিৎসা যেখানে ব্যর্থ সেখানে প্রার্থনার জোরে মানুষ নবজীবন লাভ করেছেন। রেডিয়ামের মতই আলো এবং শক্তি ছড়ায় প্রার্থনা। মানুষের শক্তি সীমিত, কিন্তু প্রার্থনার দ্বারা সে অসীম শক্তিকে ডাকতে পারে নিজের শক্তি বাড়াবার জন্যে । প্রার্থনা এমন একটি শক্তি যার দ্বারা মানুষ উপকার পায়ই।”
অনেক সময় প্রথাগত শিক্ষার বাইরেও প্রার্থনার শক্তিতে মানুষ অনেক বড় হতে পারে। এমন একজন জন. ডি. রকফেলার প্রথম জীবনে ঘন্টায় মাত্র চার সেন্টের (মার্কিন চার পয়সা) বিনিময়ে আলুক্ষেতে কাঠফাটা রোদের ভেতর লোহার কোদাল দিয়ে কাজ করেছেন। অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের বিনিময়ে তিনি পরিণত হয়েছিলেন সেই সময়কার আমেরিকার সবচেয়ে সেরা ধনীতে। প্রায় ষাট বৎসর আগে মৃত্যুর পূর্বে তিনি দু'বিলিয়ন ডলার (প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা) এর মালিক হয়েছিলেন। যার সম্পদ এখনও বেড়ে চলেছে প্রতি মিনিটে প্রায় একশ ডলার অর্থাৎ দিনে প্রায় ৭২ লক্ষ টাকা করে। যদিও তিনি মুসলিম ছিলেন না তবুও তিনি নিয়মিত প্রার্থনা করতেন, নাচতেন না, থিয়েটারে যেতেন না, কখনও মদপান এমন কি ধূমপান পর্যন্ত করতেন না ।
সার্বিক অবস্থা বিচারে তাইতো বস্তুবাদী শিক্ষার অন্যতম দার্শনিক স্ট্যানলি হল বলেন, “If you teach your children the three R's ( Reading, Writing and Arith- matics) And leave the fourth 'R' (Religion) you will get fifth `R' (Rascality)"
শেষ আহবান
এ রকম একটি প্রেক্ষাপটে নৈতিক শিক্ষাই পাশ্চাত্যের বস্তুবাদী শিক্ষার মোকাবেলায় একমাত্র উত্তম বিকল্প। সুতরাং আমাদের জন্য একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ হলোঃ নৈতিক শিক্ষাকে আরো বিস্তৃত করার পাশাপাশি, বিশ্বমানের যোগ্যতা, দক্ষতা আর প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধন। যাতে করে আর ধ্বংসোন্মুখ পাশ্চাত্যের মুখাপেক্ষী নয় বরং আমরাই দিতে পারি বিশ্বের নেতৃত্ব। শুধু নেতৃত্ব লাভের জন্যই কি এটা দরকার? না, বরং বিশ্বমানবতার কল্যাণ, অনাবিল শান্তিও এবং মানবতাকে হেফাজতের জন্যই এটা দরকার। পাশ্চাত্যের মুখে যতই বাগাড়ম্বর বুলি থাক, বুকে তাদের হতাশার ভিসুভিয়াস। আর তাইতো রাষ্ট্রীয় সকল বিরোধিতার পরও নৈতিকতা ও ধর্মীয় জীবন পাশ্চাত্যের দেশ মানুষগুলিকে জোয়ারের টানের মতোই প্রবল শক্তিতে কাছে টেনে নিচ্ছে। লন্ডন টাইমস পত্রিকা লিখেছে “পাশ্চাত্যের লোকেরা নিজেরাই নিজেদের সমাজের প্রতি নিরাশ হয়ে পড়েছে। তাতে ক্রমবর্ধমান অপরাধপ্রবণতা, পারিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংস, মাদকাসক্তি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত তারা ইসলাম প্রবর্তিত নিয়ম-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছে।”
আজকের হতাশাগ্রস্ত, ভয়াল, নিকশ বিশ্বসভ্যতার পেছনেই লুকিয়ে আছে আগামীকালের প্রদীপ্ত সত্যের সূর্য। আল্লাহর ঘোষণা বাস্তবায়িত হবেই “সত্য সমাগত, মিথ্যা অপসৃত, মিথ্যার পরাজয় অবশম্ভাবী” (আল কোরআন)
লাইট হাউস
বাংলাদেশ, সবুজ স্বদেশ, সময়ের সাম্পানে চড়ে তার অভ্যুদয়ের পর প্রায় তিনটি যুগ অতিক্রম করে যৌবনের চূড়ান্ত ধাপে এসে দাঁড়িয়েছে। সমসাময়িক কালে অথবা পরবর্তীতে জন্ম নিয়েও অনেক দেশ, বিশ্বের উন্নয়ন, ঐক্য ও সমৃদ্ধির মহাসড়কে আমাদের পিছু ফেলে ঈর্ষনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্ব, আদর্শ ও ঐতিহ্যের ঘাটতি এবং আধুনিকায়নের অভাব এর অন্যতম কারণ বলে চিন্তাশীলদের অভিমত। সমস্যা ও হতাশার বিক্ষুব্ধ অন্ধকার সাগরে জাতি আজ নিমজ্জিত। ঠিক এমনি সময়ে লাইট হাউস ল্যাবরেটরি স্কুল এন্ড কলেজের অভ্যুদয়। যেন বাতিঘর হিসেবে লাইট হাউস সে দায়িত্ব নিয়েছে দিগভ্রান্ত জাতিকে নাবিকের মতোই পথপ্রদর্শন করার।
জাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ, উন্নয়ন প্রশ্নে কঠোর পরিশ্রম, দেশের আদর্শ ও কৃষ্টির সাথে গভীর সম্পৃক্ততা এবং আধুনিকায়নের জন্য প্রচন্ড গতিবেগকে মূলধন করে একদল তরুণের প্রচেষ্টায় ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর শুক্রবার লাইট হাউসের সূচনা। লাইট হাউসের নামের ভেতরেই পরিস্ফুটিত হয় এর কর্মের পরিধি ও তাৎপর্য।
প্ৰথমত, নিষ্পাপ সত্তা হওয়ার কারণে শিশুরা আলোর তুল্য- আর তাই তাদেরকে এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে চায় আলোকিত মানুষ হিসেবে। তাদেরই নিকেতন হিসেবে এটি আলোর ঘর বা লাইট হাউস।
দ্বিতীয়ত, আজকের শিশু আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। এরা তাদের স্বকীয় প্রতিভা, যোগ্যতা ও চরিত্রপ্রভায় প্রথমত প্রতিষ্ঠানকে করবে আলোকিত, অতঃপর সমাজের সদস্য হিসেবে আলোকিত করবে সমাজ- এ অর্থে এই প্রতিষ্ঠান আলোঘর বা লাইট হাউস।
তৃতীয়ত, দিগভ্রান্ত জাতিকে শান্তি, উন্নয়ন ও আদর্শের পথে বাতিঘরের মতোই পথ দেখানোর দায়িত্ব নিয়েছে বলে এ প্রতিষ্ঠান বাতিঘর বা লাইট হাউস।
অর্থাৎ লাইট হাউসের পরিকল্পনা হচ্ছে ব্যক্তি থেকে সমাজ আর সমাজ থেকে রাষ্ট্র এবং ক্রমান্বায়ে বিশ্বকে আলোকিত করা। তাই তার শ্লোগান হচ্ছে ‘বিশ্বে হবো সেরা জাতি, নিজকে প্রথম গড়বো খাঁটি।'
লেখক: বিশিষ্ট গবেষক ও সাবেক কেন্দ্রীয় শিক্ষা কার্যক্রম সম্পাদক, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।