বুধবার, ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ড. কাজী দীন মুহাম্মদ

আমাদের শিক্ষা কিছু ভাবনা - ড. কাজী দীন মুহাম্মদ

[১]
মানুষ তার হিতাহিত জ্ঞান নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। জন্মের পরে তার আত্মীয়-স্বজন বাপ-মা পরিবেশ ইত্যাদি তাকে হিতাহিত জ্ঞানের উন্মেষে সাহায্য করে। মানুষ তার মনুষ্য বৃত্তিগুলোর বিকাশ ও প্রয়োগোপযোগিতা সাধনের জন্য বাইরের এ শিক্ষার আশ্রয় নেয়। জীবজগতের অন্যান্য শিশুর মতোই মানব শিশুও অবোধ ও অবুঝ হয়ে জন্মায়; কিন্তু মানুষ হিসেবে বাঁচতে হলে তাকে মানুষে ও পশুতে পার্থক্য করতে হয়। আর সে জ্ঞান লাভ হয় তার শিক্ষার মাধ্যমে। তাই হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতায় মানুষ তার শিশুকে সমাজের বাসোপযোগী সদস্য হিসেবে তৈরি করার চেষ্টায় নানা পদ্ধতি বের করেছে। যুগে যুগে সমাজদেহের দুষ্ট ক্ষত দূরীকরণের জন্য এবং সমাজে ন্যায় ও সত্যের প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে মহামানবের আবির্ভাব হয়েছে। তাঁরা আত্মত্যাগ করেও মানুষকে পথ দেখানোর চেষ্টা করে গেছেন। বলে গেছেন : তোমরা মানুষ, পশু নও। অন্যান্য জীবরে মতো আহার নিদ্রা মৈথুন ইত্যাদি জৈবিক প্রয়োজন মিটিয়েই তোমার সব কাজ, সব সাধনা শেষ হয়ে যায় না। তোমাদের চেষ্টা নিয়োজিত হবে দশের কল্যাণে । তোমাদের সাধণা হবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষ— আশরাফুল মখলুকাত যাতে তার শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করে ইহ ও পরকালে তার স্রষ্টার মহিমা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। আর তার কল্যাণ কামনা ও প্রচেষ্টা পরিব্যাপ্ত হবে ব্যষ্টি ও সমষ্টিতে, ব্যক্তি থেকে সমাজে, সমাজ থেকে দেশে, দেশ থেকে জাতিতে, জাতি থেকে বিশ্বে। সে যে কেবল নিজের জন্যই বাঁচে না, পরের জন্যই তার জীবন- এ কথা বুঝাবার ও বুঝাবার পরিশীলনীর নামই প্রকৃত শিক্ষা৷ শিক্ষা প্রকৃত প্রস্তাবে জীবন যাপন।


শিক্ষা: জীবন যাপন প্রণালির পদ্ধতি শিক্ষা। বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে বিভিন্ন আহার্য, বিভিন্ন বাতাবরণ ও বিভিন্ন প্রকৃতিতে তার জীবন যাপনোপযোগী রসদ সংগ্রহ করে বাঁচার ও বাঁচানোর যে পদ্ধতি, তার সম্যক শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। শিক্ষাই মানুষকে ভাল মন্দ, সুন্দর-অসুন্দর, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-অসত্যের মধ্যে তারতম্য বোধ এনে দেয়। এ বোধকে শাণিত শক্ত সমর্থ করে, এ বোধের ধারা-পদ্ধতি অনুসরণই মানব জীবনের লক্ষ্য। অকল্যাণ থেকে কল্যাণে মনুষ্য জীবনের তথা বিশ্বজীবনের পথ নির্দেশক যে শিক্ষা তারই পরিশীলনী মানবজীবনের প্রথম ও প্রধান কর্তব্য। পরহিতে স্বার্থত্যাগ ও আত্মোৎসর্গই শিক্ষার সামাজিক ও আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য।

মানুষ বিবেকসম্পন্ন বুদ্ধিমান জীব। অতএব তাকে সমাজে বাস করতে হলে তার মন-প্রাণ-মস্তিষ্ক এ তিনেরই উৎকর্ষ সাধন প্রয়োজন। এ তিনের উৎকর্ষের জন্য যে শিক্ষা, সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। আল্লাহ মানুষকে লক্ষ্য করে বলেছেন : ওয়ালা তা'তাদু ইন্নাল্লাহা লাইয়ুহিরুল মু'তাদীন- তোমরা সীমা অতিক্রম করো না, কেননা আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীকে পছন্দ করেন না। যে শিক্ষা মানুষের ফিতরার বা স্বভাবের পরিপোষক এবং নিজের ও অপরের কল্যাণকর তাই সবার জন্য ওয়াজিব । হযরত রাসূলে করীম (সা) বলেছেন : আল ইলমু ফরিদাতুন আলা কল্লি মুসলেমিনা ওয়া মুসলেমাতিন- প্রতিটি নর এবং নারীর জন্য ইলম হাসিল বা জ্ঞান অর্জন করা ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য ।

আমাদের শিক্ষায় জীবন যাপনের সব রকমের ব্যবস্থা থাকবে। কেবলমাত্র জীবিকা অর্জনের শিক্ষাই সম্পূর্ণ শিক্ষা নয়। কেননা, মানুষের খাওয়া পরার পরই অন্তরের পিপাসা ও মনের ক্ষুধার কথা আসে। আর তাই তাকে মানুষের অধ্যাত্ম দিকটিকেও সমাজেই উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করে তুলতে হবে। মনুষ্যত্ববোধকে বিকশিত না করলে, তার পশুত্বই প্রবল হবে এবং মনুষ্য জীবনের উদ্দিষ্ট ভূমিকা সে সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারবে না। আবার কেবলমাত্র অধ্যাত্ম্য শিক্ষাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। যে শিক্ষা তাকে মনুষ্যত্ব বিকাশের পথ শিখাল অথচ তার জৈবিক দিকটিকে অস্বীকার করল তাও প্রকৃত শিক্ষা নয়। সুতরাং, যে শিক্ষায় এ দুয়ের সমন্বয় সাধন করে মানুষকে খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে এবং স্বার্থ ত্যাগে উদ্বুদ্ধ করে, মানবতার কল্যাণে আত্মত্যাগে অনুপ্রাণিত করে, সে শিক্ষাই সবার কাম্য। কল্যাণকর সুশিক্ষাই শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। সুশিক্ষিত সেকান্দর জুলকারনাইন তাই বলেছেন: To my father I owe my life but to Aristotle I owe how to live worthily.

যে আদর্শ শিক্ষা সত্যিকার মহৎজীবন যাপনে উদ্বুদ্ধ করে তা-ই প্রকৃত শিক্ষা। আর সে শিক্ষা গ্রহণের জন্যই নিজ গ্রাম নিজ দেশ ত্যাগ করে বহু দূর দেশে যেতেও ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। এ শিক্ষার জন্যই এ জ্ঞান সাধনার জন্যই নির্দেশ রয়েছে ; উতলুবুল ইলমা ওয়ালাও কানা বিসসীন- সুদূর চীন দেশে গিয়ে হলেও বিদ্যার্জন কর । সে কালে যানবাহনের প্রাচুর্য ও সুযোগ সুবিধা এ কালের মতো ছিল না। আরব দেশ থেকে চীন দেশ বহুদূর জেনেও ইসলাম ইলম হাসিলের জন্য, বিদ্যার্জনের জন্য সে দেশে যেতে পরামর্শ দিয়েছে।

মূর্খ লোক পশুর সমান। সে কেবল নির্বোধ ও অজ্ঞানই নয়, সে সমাজের বুকে দুষ্ট ব্রনের মতো। নিজেও অধঃপাতে যায়, অপর সকলকেও অতলে নিমজ্জিত করে। তাই অজ্ঞতা মূর্খতা দূরীকরণের জন্য সবকালে সবদেশে সাধনা চলেছে। আজ আমরা যে বিজ্ঞানের উন্নতি লক্ষ্য করছি তা জ্ঞান সাধনারই এক শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। মানবকল্যাণে জীবন নিয়োজিত করবে, নিজের জীবনকে সুখী সমৃদ্ধশালী করে তুলবে এবং সঙ্গে সঙ্গে অপরের কল্যাণও চিন্তা করবে, সত্য ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করবে এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুন্দর করে তুলবে। আর এ করতে হলে চাই সুশিক্ষিত সুস্থ মস্তিষ্কের যোগ্য নাগরিক। সমাজে যোগ্য নাগরিক এবং প্রকৃত মানুষ হিসেবে বাস করতে হলে, মানুষকে প্রকৃত শিক্ষার দ্বারস্থ হতেই হবে। শিক্ষাই মানুষে মানুষে ভেদাভেদ, সাদায় কালোয়, ধনী দরিদ্রের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দিয়ে এক বিশ্ব মানবতার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে সাহায্য করবে।

কর্মহীন শিক্ষা যেমন অবাস্তব, ধর্মহীন শিক্ষা তেমনিই অমার্জনীয়। কর্ম শিক্ষা মানুষকে বাঁচাতে শিখায়। কিন্তু ধর্মশিক্ষা মানুষকে যোগ্য নাগরিক রূপে বাঁচতে ও চিন্তা করতে শেখায়। কাজেই উভয় পদ্ধতির সমন্বয়ে যে শিক্ষা সে আদর্শ শিক্ষাই সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে আনতে সমর্থ। মহান আল্লাহ মানুষকে বিবেকসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাকে মানবিকতার সমস্ত গুণ ও পাশবিকতার সবগুণের সমন্বিত আধাররূপে সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করে ইচ্ছা করেছেন যেন মানুষ তার শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা রক্ষা করে এবং পশুত্বের দমন করে। মানুষের মধ্যে যে মানবতা দিয়েছেন তার পরিচর্যা করে, পশুত্বের ধ্বংস সাধন করে, প্রকৃত মানব নামের উপযুক্ত হওয়ার চেষ্টা ও সাধনারই সংগ্রাম এ জীবন। এ জীবনকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করে তুলতে হলে চাই সত্য-মিথ্যার, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য সৃষ্টির জ্ঞান। আর যথোপযুক্ত শিক্ষার বা সাধনার পরিশীলনীতেই এ জ্ঞান বিধৃত।

মানুষকে মানুষ হিসেবে বাঁচতে হলে সমাজবদ্ধ হয়ে বাস করতে হয়। একে অন্যের প্রতি নির্ভরশীল এ সমাজ মানব বুদ্ধির ও মানব সংস্কৃতির এক অমোঘ নিয়মে পরিচালিত। আল্লাহর বিধান মেনে চলতে হলে, প্রকৃতির কোথাও কোন ব্যাঘাত না ঘটিয়ে প্রতিটি কাজ যথাযথভাবে পরিচালিত হলেই ব্যষ্টি ও সমষ্টির জীবন হয় সহজ সরল ও সুন্দর। এ সুন্দরই পরম সত্য। আর সত্যই সুন্দর। অসত্যই অসুন্দর। এবং অসুন্দর ও অসত্যই মানবতাবিরোধী তথা জীবনবিরোধী। ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের অশান্তি—অন্ধকার দূরীকরণের জন্য সুস্থ সমাজ চেতনা ও মানবতা বোধের জাগৃতি ও উদ্বোধনের জন্য, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এক বিশাল দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকায় অংশগ্রহণ করতে হয়। আর সে অংশগ্রহণে বিশৃঙ্খলা থাকলে জীবন সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পরিচালিত হতে পারে না। মানুষকে জীবনে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, সন্তান-সন্ততি ইত্যাদি নানা ধরনের দায়িত্ব পালন করতে হয়। আর এ দায়িত্ব পালনের মহড়ার অনুশীলন শিক্ষার ওপর নির্ভরশীল। প্রতিবেশীর প্রতি মানুষের কর্তব্য এতিম দুঃখীর প্রতি তার দায়িত্ব, এবং মনিব-ভৃত্য, ছোট-বড়, আপন-পর, সবার সঙ্গে তার জীবন-যাপনে কর্তব্য পালন সম্বন্ধে সম্যক শিক্ষা না পেলে, জীবন যাপন প্রণালি শিক্ষার মাধ্যমে অনুশীলিত ও পরিচ্ছন্ন না হলে, সে জীবন পশুবৃত্তি পরিচর্যায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে তার চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। চরিত্রই মানুষের অমূল্য সম্পদ। এ চরিত্র একবার পরিমার্জিত ও সংস্কৃত হয়ে গেলে জীবনযাপন হয় সহজাত সুষ্ঠু ও সুন্দর। দেশ, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তির সেবা থেকে আরম্ভ করে বিশ্বনিয়ন্তার প্রীতি লাভের স্তর পর্যন্ত নানাভাবে নানা কর্মের ভেতর দিয়ে পরিচ্ছন্ন মনের ও সংস্কৃত মানসের বিকাশ সম্ভবপর হয়ে ওঠে। মানব প্রবৃত্তি শিক্ষার আলোকে উজ্জ্বল না হলে জ্ঞানহীন অন্ধকার জীবন যাপনই হয়ে পড়ে অবশ্যম্ভাবী। আর সে জীবনই মানবতা বিরোধী জীবন।

কেবল ইহকালের এ জীবন যাপনই নয়, পরকালের চিন্তায় নিয়োজিত সত্যসুন্দর জীবনযাপনের জন্যও এ দুনিয়াই কর্মক্ষেত্র। বলা হয়েছে: ‘আদদুনিয়া মাজরাআতুল আখিরা' এ দুনিয়া আখিরাতের শস্যক্ষেত্র। এখানকার কর্মের মাধ্যমেই পরকালের পথের সম্বল সঞ্চয় সম্ভব। আর এ কর্ম পদ্ধতি শিক্ষার মাধ্যমে পরিশীলিত না হলে জীবন ব্যর্থ হয়ে পড়তে বাধ্য ।

শিক্ষা মানুষকে এ দুনিয়ায় হালাল রুজি অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত করবে এবং সমাজ ও দেশের কল্যাণ কামনায় নিয়োজিত করবে। আর ঈমান ও আকিদার পরিচ্ছন্নতা সাধন করে বান্দার ও আল্লাহর হক আদায়ে সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রতি দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করবে।

সে জন্যই ইলম বা জ্ঞান অনুসন্ধান অবশ্য পালনীয় কর্ম বা ফরয করে দেয়া হয়েছে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জীবনপদ্ধতি ইসলামে ইলমের বিপরীতধর্ম বা স্বভাবকে বলা হয়েছে, যুলুমাত বা অন্ধকার আর ইলমকে বলা হয়েছে, ‘নূর’ বা আলো। তাই সবাইকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে ইলম বা জ্ঞান হাসিল করার জন্য। এ বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য সম্বন্ধে চিন্তা করার জন্য, সত্য উদঘাটন করার জন্য, গবেষণা করার জন্য, বারবার বলা হয়েছে। জ্ঞান লাভ না করলে নিজেকেই চেনা যায় না, বিশ্বকে তথা তার প্রতিপালক স্রষ্টাকে কি করে জানা যাবে? মান আরাফা নাফসাহু ফাকাদ আরাফা রাব্বাহু- যে নিজেকে চিনেছে, সে-ই তার প্রতিপালককে চিনেছে। জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশ না করলে তাকে জানা কখনও সম্ভবপর হয় না।

জ্ঞান অর্জন যেমন ফরয, তেমনি জ্ঞান দান করা, ইলম বিতরণ করাও সওয়াবের কাজ। নিঃস্বার্থভাবে জ্ঞান দান করবে। হযরত আলী (রা) বলেছেন: ফাকুম বিইলমি ওয়ালা তাবগি লাহু, বাদালান, ফান্নাসু মাওতা ওয়া আহলিল ইলমি আহইয়াউ- জ্ঞান ধারণ কর এবং তা বিতরণের বিনিময়ে কোন মূল্য কামনা করো না। কেননা মানুষ মরে যায়, কিন্তু জ্ঞানের অধিকারীরা চিরজীবী। মানুষকে শিক্ষা দেয়া বড় তাবলিগ। বিপদে আপদে সদুপদেশ দান পরম নেক কাজ।

সাধক পুরুষ মহাকবি শেখ শা'দী ধন সম্পদ দান সম্বন্ধে বলেছেন: আজই তোমার ধন ভাণ্ডারের কুঞ্চিকা অপরের হাতে দিতে কুণ্ঠিত হয়ো না, কেননা কালই সে ধন ভাণ্ডারের কুঞ্চিকা তোমার হাতে নাও থাকতে পারে।
ধন দান সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে, জ্ঞান বা ইলম বিতরণ সম্বন্ধেও সেই কথাই প্রযোজ্য। কবি সত্যি বলেছেন:

জ্ঞান-পরিচ্ছদ আর ধর্ম-অলঙ্কার,
করে মাত্র মানুষের মহত্ত্ব বিস্তার।
এই ধন কেহ নাহি নিতে পারে কেড়ে,
যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে।

Plain living and high thinking শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। একথা আগেই বলা হয়েছে যে, সে শিক্ষাই উত্তম, যে শিক্ষা মানুষকে এই পার্থিব জীবন সংগ্রামে বেঁচে থাকার কৌশল শিখায় এবং সঙ্গে সঙ্গে মানুষের নৈতিক চরিত্র গঠনেও সহায়ক হয়। কেবলমাত্র পার্থিব রুজি রোজগারের উপায় আয়ত্ত করায় জীবন একদেশদর্শী হয়ে পড়ে। কেবল নৈতিক শিক্ষা বা ধর্মীয় শিক্ষা যেমন জীবনকে করে ফেলতে পারে পঙ্গু তেমনি কেবল জীবিকা অর্জনের শিক্ষাও নিয়ে যায় পঙ্গুত্বের কাছাকাছি। ধর্মীয় ও জাগতিক উভয়বিদ শিক্ষার সমন্বয় জীবনকে করে তুলতে পারে সার্থক। সে জীবনই সংসারের পাপ-পঙ্কিল ধরার ধুলায় বাস করেও চলার পথ করে তোলে সুন্দর মসৃণ। পরকালেও তার সাফল্য অবশ্যম্ভাবী।

কোন এক ইংরেজ মনীষী বলেছেন যে, শিক্ষার্থীকে কেবল রুজির পন্থা শিখালে, তাতে যদি নৈতিক শিক্ষার সম্মিলন না ঘটে, তবে সে শিক্ষায় মানুষ সুশিক্ষিত হয় না। কুশিক্ষিত হয়। If you give them three 'Rs' ie Reading, writting and arithmatic, and do not give them the fourth 'R'i.e Religion, they are sure to become the fifth Rice Rascal— শিক্ষার্থীদের কেবলমাত্র পঠন, লিখন ও অংক কষা শিখালে এবং ধর্ম না শিখালে তারা ‘দুষ্ট’ হতে বাধ্য। কাজেই যে শিক্ষা নীতিবিগর্হিত সে শিক্ষা কারো কাম্য নয়।

এই উপদেশটি আজকের দিনে আমাদের দেশে বেশি প্রযোজ্য। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় Fourth R Religion তার জীবনে কোনই প্রভাব বিস্তায় করতে পারছে না। সুতরাং মানব শিশুকে মানুষ করে তুলতে হলে তার শিক্ষা ব্যবস্থায় Fourth R (Religion) এর প্রয়োজনীয়তা অবশ্য স্বীকার্য।

একথা আগেই বলা হয়েছে যে, ভাল ও মন্দ, আলো ও আঁধার, সুন্দর ও অসুন্দর, হিত ও অহিত ন্যায় ও অন্যায় হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করার জ্ঞান অর্জন‍ই প্রকৃত ইলম হাসিলের প্রশিক্ষণের প্রধান ও প্রথম উদ্দেশ্য। যাতে মানুষ শাশ্বত জীবনের অমরত্বের বিশ্বাস নিয়ে, কর্মে প্রযুক্ত হয়ে সৃষ্টির সেবায় নিবেদিতপ্রাণ ‘মুসলিম’ হতে পারে এবং ইহকালের কর্মপ্রেরণায়, পরজীবনের হিদায়াতের সন্ধান পায়, তার প্রশিক্ষণই প্রকৃত শিক্ষার লক্ষ্য। শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা অর্জন মাত্র নয়। শিক্ষা আমাদের জ্ঞানকে করে পরিচ্ছন্ন, বুদ্ধিকে করে শাণিত, দৃষ্টিকে করে প্রসারিত আর জীবনকে করে তোলে সংস্কৃত ও সুন্দর । মানুষের সংস্কৃতির ধারা প্রবাহ গতিশীল এবং স্থান কাল পাত্র উপযোগী করার যে শিক্ষা, সে শিক্ষাই আদর্শ শিক্ষা।

জনৈক ইংরেজ মনীষী বলেছেন: Education does no necessarily mean mere equisition of Degrees and Diplomas, It emphasises the need for acquisition of knowledge to live a worthy life. A balanced acquisition of techniques to fight against odds in order to pave the paths of peace for mankind and to fight for survival before and after death is recomended for the gradual cultural development and smooth running of human civiliza- tion.

মানুষের বাঁচার জন্য ও অপরকে বাঁচতে দেয়ার জন্যই শিক্ষার দরকার। কেবল তাই নয়, শিক্ষার দরকার জীবন যাপনে সেবায় নিয়োজিত হওয়ার এবং মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির গতিধারা রক্ষার জন্যও। কেবল কিছু ডিগ্রি ডিপ্লোমা বা সনদ জোগাড় করাই যে শিক্ষার উদ্দেশ্য তা জীবন বোধে সর্বত্র সমৃদ্ধ নয়। তাই তা পরিত্যাজ্য। এ সম্বন্ধে সংস্কৃতির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে শিক্ষা সম্বন্ধে TS Eliot বলেছেন: The purpose of education has been defined as the making people happier. That the educated person is happier than the undu- cated is by no means self-evident. Those who are conscious of their lack of education are discontented, if they cherish ambi- tions to excel in occupation for which they are not qualified, they are sometimes discontented, simply because they have been given to understand that more education would have made them happier. Many of us feel some grievances against our elders, our schools or our universities for not having done better by us. This can be way of extrenuating our own short- comings and excusing our failure. To be trained, taught or instructed above the level of over abilites and strength may be disastrous; for education is a strain and can impose greater burdens upon a mind than that mind can bear. Too much education, like too little education, can produce unhappiness.2


॥২॥
মানুষকে দুটো কাজের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে : ইবাদত ও খিলাফত। মানুষ স্রষ্টার ইবাদত ও সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। আর সে যে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ আল্লাহর খলিফা; তার পরিচর্যা করবে। আর জ্ঞান ব্যতীত এ দু'টোর কোনটিই সম্ভব নয়। কিন্তু সে জ্ঞান মানুষের গ্রহণ ক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে; কম হলেও চলবে না, অতিরিক্ত হলেও বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন: জ্ঞানের প্রধান অংশ হচ্ছে মানবপ্রেম। পাপী পুণ্যবান নির্বিশেষে মানব সমাজের মঙ্গল সাধনই হলো জীবনের আদর্শ। তিনি আরো বরেছেন: জ্ঞানীর কালি শহীদের রক্তের চাইতেও মূল্যবান। জ্ঞান ক্ষুরধার। জ্ঞান মুজাহিদের তরবারির চাইতেও ধারাল শাণিত। অজ্ঞান-তমসা দূর করে আলোর বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে জ্ঞানের তুলনীয় কিছুই নাই । জ্ঞানের দ্বারাই এ দুনিয়ার দ্বন্দ্ব ফ্যাসাদ হিংসা বিদ্বেষ কলহ বিদূরিত করা যায়, মানুষে মানুষে ভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর বন্ধন সৃষ্টি করা যায় ।

জ্ঞানই শক্তি। জ্ঞানহীনতা দুর্বলতা ও মৃত্যু। জ্ঞানের মতো ঐশ্বর্য নেই। বলা হয়েছে: সকল ধনের সার বিদ্যা মহাধন। জ্ঞানের সাহায্যেই অসম্ভবকে সম্ভব করা যায়। জ্ঞানই শত্রুকে মিত্র করতে, দুশমনকে দোসত করতে সাহায্য করে। জ্ঞান জীবন যাপন পদ্ধতি তথা ধর্ম বোঝার সহায়ক। জ্ঞানহীন লোক কোনদিন শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা লাভ করতে পারে না। জ্ঞান আলো, অজ্ঞানতা অন্ধকার। আল্লাহতায়ালা আল-কোরআনে বলেছেন : আঁধার আর আলো কি সমান? তোমরা কী চিন্তা করো না? যে নির্বোধ মূক ও বধির অর্থাৎ যে শোনে না, দেখে না, বলে না এবং বোঝে না, আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি নিরেট পশুর মতো। জ্ঞান মানুষের ভেতর ও বাহির স্বচ্ছ ও নির্মল করে তোলে, মন ও মস্তিষ্কের মোক্ষণ সাধন করে। বিবেক বুদ্ধি ও যুক্তির প্রসারণ ও নিয়ন্ত্রণ এ জ্ঞানেরই অধীনে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে : যাকে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে তাকে প্রভূত কল্যাণ দেয়া হয়েছে। জ্ঞানেই কল্যাণ জ্ঞানেই মুক্তি। তাই জ্ঞান লাভ করার অধিকার সকলেরই। আর সে অধিকারের সদ্ব্যবহারই আমাদের জীবনকে করে তোলে সুন্দর ও সুসমঞ্জস। জ্ঞানানুশীলনকে সারারাত ইবাদতের চাইতেও শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। হযরত (সা) বলেছেন, যে জ্ঞানের অনুসন্ধান করে তার আগের সব পাপ মাফ হয়ে যায়। তিনি আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি বিদ্যার্জন করতে করতে অর্থাৎ ছাত্রাবস্থায় মৃত্যুবরণ করে সে নিষ্পাপ। কেউ বিদ্যা অর্জনের জন্য বের হলে, ফিরে না আসা পর্যন্ত সে আল্লাহর পথেই থাকে। যে শিক্ষা সত্যিকার মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে হয় সহায়ক, সবার প্রতি কর্তব্যবোধে করে উজ্জীবিত, স্রষ্টার প্রতি করে বিনীত, সেই শিক্ষাই কাম্য। শাস্ত্র বলে বিদ্যা দদাতি বিনয়ং— বিদ্যা বিনয় জননী। বিদ্যাই মানুষকে মনুষ্যত্ব বোধে উজ্জীবিত করে পশুত্বের পর্যায়ে থেকে আলাদা করে। সেজন্যই বিদ্যা অর্জনে যত্নবান হওয়ার তাগিদ সকল ধর্মেই দেয়া হয়েছে। বিনয়, নম্রতা, মানুষের মহত্ত্ব বাড়ায়, জীবনকে সুন্দর করার জন্য মানুষ সত্যিকার শিক্ষায় শিক্ষিত হবে। মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক, মানুষের সঙ্গে মানুষের জীবজগতের সম্পর্ক, তার পরিপার্শ্বস্থ জড়-অজড় জগতের সবকিছুর সম্পর্ক এবং এদের যথাযথ প্রাপ্য ও দেয় হক সবকিছুরই জ্ঞান শিক্ষা ব্যবস্থায় সন্নিবিষ্ট থাকবে। মানুষ সত্যাসত্য, ন্যায়-অন্যায়, ভালমন্দ, সুন্দর-অসুন্দরের পার্থক্য জেনে জীবনকে করে তুলবে পরিচ্ছন্ন নির্মল। জীবন থেকে মিথ্যা, অন্যায় ও অসুন্দর দূর করে সত্য ন্যায় ও সুন্দরের প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সুন্দর, সহজ, সরল জীবন, বিনয়, নম্রতা ও মহত্ত্বে উজ্জীবিত আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ এবং মানব কল্যাণে নিয়োজিত জীবনই সত্যিকার জীবন। আর যে শিক্ষায় এসবের সমন্বয় ঘটে সে শিক্ষাই সবার উপযোগী। যে সব গুণের অনুশীলনীর মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত মনুষ্য পদবাচ্য হতে পারে, আল্লাহর গুণে বিভূষিত হতে পারে, আল্লাহর প্রকৃত খলিফা বা প্রতিনিধি হতে পারে, সে সব গুণের সমাবেশেই জীবন সুন্দর হয়ে ওঠে। আর এই সুন্দর জীবনের সব গুণ শিক্ষা ব্যবস্থায় না থাকলে সে শিক্ষা কখনও সার্থক হতে পারে না আর ইসলাম এই বিশ্বজনীন শিক্ষারই পরিপোষক ও প্রচারক।

ইসলামের স্বর্ণযুগে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে কোন পার্থক্য চিহ্নিত হয়নি। সব রকমের শিক্ষাকেই ধর্মীয় অঙ্গনে স্থান দেয়া হয়। এ সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালে জনৈক ইউরোপীয় লেখকের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি। এতে বলা হয়েছে: ইসলামের এক গৌরবময় কীর্তি হচ্ছে, ইসলাম কুরআন, হাদীস ও মুসলিম বিধান-শাস্ত্র ফিকাহর অধ্যয়ন ও অনুশীলনের অনুরূপ অন্যসব জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনাকেও সমান আসন ও মর্যাদা দান করেছে এবং মসজিদে তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

মসজিদে কুরআন, হাদীস ও ফিকাহর ওপর আলোচনার সঙ্গে একই ভাবে রসায়ন, পদার্থবিদ্যা, ভেষজবিজ্ঞান এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরও আলোচনা করা হতো। কেননা, স্বর্ণযুগে মসজিদই ছিল ইসলামের বিশ্ববিদ্যালয়। দেশ, জাতি, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের প্রতিক্ষেত্র ও প্রতি প্রান্ত থেকে লব্ধ সাধনা ও সে যুগের সমস্ত জ্ঞানধারাকে সেদিন মসজিদের অঙ্গনে সাদরে বরণ করা হতো। এই আশ্চর্য বৈচিত্র্যময় সম্মিলন আর সর্বজ্ঞানের চরম উৎকর্ষই প্রাচীন মুসলিম মনীষীদের চিন্তাধারায় এক অনুপম বৈশিষ্ট্য দান করেছে— যা তাঁদের প্রতিটি পাঠকের মনেই রেখাপাত করে। এ হচ্ছে বিদগ্ধ মনের এক শান্ত স্থির মহিমময় রূপ।

ইসলামে ‘ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ' এবং ‘ধর্মবাদের' মত কোন মতবাদের অস্তিত্ব নেই; কেননা, খাঁটি ধর্ম মানুষের উদ্যম ও কর্মধারা সমগ্র পরিসরকেই তার আওতাভুক্ত করে । পবিত্র কুরআনে ভাল ও মন্দ তথা সুকৃতি ও দুষ্কৃতির মধ্যে পার্থক্য চিহ্নিত করা হয়েছে। সুকৃতি মানুষের বিকাশ ও উন্নয়নের সহায়ক, আর দুষ্কৃতি এর পক্ষে চরম হানিকর। ইসলাম মুক্তবুদ্ধিবাদী ধর্ম। এ ধর্মে সে মানুষের স্থান নেই, যে সেন্ট অগাস্টিনের সঙ্গে স্বর মিলিয়ে বলে : Credo quia absurdumest- ‘আমি বিশ্বাস করি, যেহেতু অলৌকিক ও অবিশ্বাস্য।” আল-কোরআন বার বার অযৌক্তিক বা মুক্তবুদ্ধি বর্জিত ধর্মকে বাতিল ঘোষণা করেছে। কেননা কুরআনের দৃষ্টিতে যুক্তিহীন ধর্মমত ধর্ম হিসেবে সম্পূর্ণ বাতিল ও অন্তঃসারশূন্য। বার বার কুরআন ধর্মীয় ক্ষেত্রে যুক্তি ও সাধারণ বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের জন্য মানুষের প্রতি আহবান জানিয়েছে। সমস্ত ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা একথা প্রমাণ করে, যে সব জাতি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস হারায়, তাদের অধঃপতন অনিবার্য। আল্লাহর প্রতি জাগ্রত বিশ্বাস এবং প্রশস্ত মুক্তবুদ্ধি-এ দুটো কি সংগতিবিহীন? পাশ্চাত্যের একশ্রেণীর বেশ কিছুসংখ্যক চিন্তাবিদ মনে করেন, এ দুয়ের মধ্যে কোন সংগতি থাকতে পারে না কিন্তু ইসলাম প্রমাণ করেছে, এ দু'টো বিষয় সম্পূর্ণভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সমন্বয়শীল, এ দু'টি সম্পূরক।

সাফল্যের ফলবাহী ইসলামের প্রাথমিক শতাব্দীগুলোতে প্রতিটি বৈষয়িক ক্ষেত্রে আল্লাহর প্রতি অবিমিশ্র বিশ্বাসের সঙ্গে মুক্তবুদ্ধির সমন্বয় সাধন করা হয়েছিল। কারণ, ইসলাম পৃথিবীর ওপর এমন কোন কিছুকেই এত পবিত্র মনে করে না, যা সমালোচনা মুক্ত বা সমালোচনার নাগালের বাইরে। কেবল অসীম অলৌকিক একজন মাত্র আছেন - অকল্পনীয় অদ্বিতীয় সত্তা এমন একজন, যার একত্বে একবার বিশ্বাস স্থাপনের পর আর কোন আলোচনার অবকাশ থাকে না। তিনি সকলের জন্য সার্বজনীনভাবে মঙ্গলময় ও দয়ালু। তিনি মানুষকে যুক্তি, প্রজ্ঞা ও কার্যকারণ নিরূপণের প্রতিভা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। মুসলিম মনীষী লেখকরা মানুষের প্রতি আল্লাহর শ্রেষ্ঠতম দান হিসেবে এ ‘কার্যকারণ’ জ্ঞানকে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। যা শুভ ও কল্যাণকর তার অনুসরণ এবং যা মন্দ ও অকল্যাণকর তার পথ বর্জনের উদ্দেশ্য নিয়ে মানুষ যাতে সম্পূর্ণ অবাধে আল্লাহর নামে তার এই বিচারবুদ্ধি ও কার্যকারণ জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারে, সে জন্যেই আল্লাহ তাকে এ ক্ষমতা দান করেছেন। আর এ উদ্দেশ্যের অনুসরণের ক্ষেত্রে পবিত্র সংবিধানে পথনির্দেশ ও রক্ষাকবচের ব্যবস্থা রয়েছে।

ইসলামে কোন পৌরহিত্যবাদ নেই। অন্যান্য ধর্মে সবরকম অধিকার ও কার্যক্রম অস্বাভাবিকভাবে পুরোহিত সম্প্রদায়ের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় এসব অধিকার ও দায়িত্ব প্রত্যেক ব্যক্তি-মানুষের ওপর আরোপ করা হয়েছে। সুতরাং এ উদার দৃষ্টিভঙ্গির ফলে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ব্যক্তিগণ স্বাভাবিকভাবেই নেতৃত্ব লাভ করেন।


॥৩॥
কোন নরনারীর জীবনে চলার পথে আলোক সঞ্চারের পক্ষে একজন জ্ঞানহীন ব্যক্তি হচ্ছে একটি তৈলবিহীন প্রদীপের মতো, তাই এই যুক্তি জ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সাধনের সঙ্গে সর্বজনীন শিক্ষার নির্দেশে বিধৃত হয়েছে। মহানবী (সা:) বলেছেন: “জ্ঞানা নুশীলন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর জন্য অবশ্য কর্তব্য বা ফরয।”

এভাবে দেড়হাজার বছর আগের নর ও নারীর উভয়ের জন্যই সর্বজনীন শিক্ষা ইসলামের পবিত্র সংবিধানের অন্তর্ভুক্ত হয়। পরে পাশ্চাত্য সভ্যতা একে সাদরে বরণ করে নেয়। এ কথাও বলা হয়েছে : “জ্ঞানই শক্তি।” নিম্নোক্ত নির্ভরযোগ্য হাদীসটি থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায়, জ্ঞানানুশীলনের ওপরই কেবলমাত্র গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি— জনসাধারণের মধ্যে জ্ঞান বিস্তারের ওপর সমান গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে : “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর বান্দাদের কাছ থেকে জ্ঞান ছিনিয়ে নেবেন না, প্রকৃতপক্ষে তিনি পৃথিবী থেকে জ্ঞান সাধকদের উঠিয়ে নিয়ে জ্ঞানের ক্ষেত্রে শূন্যতা সৃষ্টি করবেন। এর ফলে এমন অবস্থার উদ্ভব হবে যে, কোথাও কোন খাঁটি ব্যক্তি বা আলেম অবশিষ্ট থাকবে না। তখন মানুষ তাদের নেতা বা পথপ্রদর্শক হিসেবে মূর্খদের বরণ করবে এবং তাদের নানা বিষয়ে প্রশ্ন করবে (নানা বিষয় সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাইবে) এবং তারা (সেই মূর্খ নেতাগণ) কোন রূপ জ্ঞান ব্যতিরেকেই ফতোয়া দান করবে। (এর ফলে) তারা নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে এবং অপরকেও পথ ভ্রষ্ট করবে।”

এ উক্তিতে ইসলামের বর্তমান অবস্থা সুস্পষ্টভাবে চিত্রিত হয়েছে। আমাদের মধ্য এখন এমন বহু সংকীর্ণচিত্ত আলেমও দেখা যায়, যাঁদের জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহের কারণ রয়েছে। তবে এখানে জ্ঞান শব্দটি যে অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তাদের মধ্যে যে জ্ঞান রয়েছে, তা তার চেয়ে অনেক বেশি প্রশস্ততর এবং অধিকতর মানবীয় । এছাড়াও মহানবী (সা) বলেছেন : ‘জ্ঞান সাধকের কলমের কালি শহীদের রক্তের চাইতেও পবিত্রতর।' তিনি আরো বলেন : ‘আল্লাহর সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার নীরব চিন্তা ও গবেষণা এক বছরের এবাদতের চাইতেও উত্তম।' তাঁর অন্য এক উক্তিতে আছে: ‘যে জ্ঞানাসাধনা করে, সে আমার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে।” ‘প্রথমে যে জিনিস সৃষ্টি করা হয়েছিল তা হল- বিচার বুদ্ধি বা কার্যকারণ জ্ঞান। আল্লাহ বিচার বুদ্ধির চেয়ে উৎকৃষ্ট কোন কিছুই সৃষ্টি করেননি। এর দ্বারাই আল্লাহ আমাদের কল্যাণ বিধান করেছেন এবং এর সাহায্যেই আমরা সবকিছু বুঝি ও অনুধাবন করি । আর এই জন্যই আল্লাহর সন্তুষ্টির কারণ ঘটে থাকে এবং এর মধ্যেই পুরস্কার ও শাস্তির কারণ নিহিত রয়েছে।' তিনি বলেন : জ্ঞান সাধকের কথা শোনা এবং অন্যদের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রেরণা সৃষ্টি দীনী এবাদত অনুশীলনের চাইতেও মহত্তর। ‘যে জ্ঞান সাধনার উদ্দেশ্যে গৃহ ত্যাগ করে সে আল্লাহর রাস্তায় পদচারণা করে।’ ‘জ্ঞান তার অধিকারীকে মন্দ থেকে ভাল কিংবা দুষ্কৃতি থেকে সুকৃতির পার্থক্য নিরূপণে সাহায্য করে; জ্ঞান বেহেশতগামী পথকে আলোকিত করে। উষর মরুতে এ আমাদের বন্ধু, নিভৃতবাসে আমাদের সমাজ আর বন্ধুহীন অবস্থায় আমাদের সহচর। এ সুখের পথের সন্ধান দেয় এবং দুঃখের গুরুভার বহনের শক্তিদান করে । বন্ধুদের মধ্যে এ হচ্ছে একটি ভূষণ এবং দুশমনদের বিরুদ্ধে এ হচ্ছে এক দুর্ভেদ্য বর্ম।' ‘দেখ ফেরেশতাগণ জ্ঞান সাধকের ওপর তাদের আলোর পাখা বিস্তার করেছে। যাদের জ্ঞান আছে যাদের জ্ঞান নেই তারা কি সমপর্যায় ভুক্ত? জ্ঞানী ব্যক্তির স্থান ধর্মব্রতীর উপরে; যেমন আমার স্থান তোমাদের মধ্যে সবচাইতে অধস্তন ব্যক্তির উপরে।

তিনি বলেন, ‘একজন মানুষ সালাত, সিয়াম, যাকাত, দানখয়রাত ও হজ অনুষ্ঠান এবং অন্যসব ধর্মীয় কর্তব্য পালন করতে পারে; কিন্তু জীবনে যে পরিমাণ সাধারণ বিচার বুদ্ধি দিয়ে সে পরিচালিত হয়েছে, ঠিক সেই অনুপাতেই তাকে পুরস্কৃত করা হবে। তিনি আরো বলেন, জ্ঞান আছে অথচ যে তা জীবনে চলার পথে প্রয়োগ করতে জানে না, সে বইয়ের বোঝাবাহী একটি গাধার মতো।”

ইসলামে কোন অজ্ঞ মুসলমানের অস্তিত্বের কথা, পবিত্র কুরআনে কোন জাহেল মুসলমানের কথা কখনো ধারণা করা হয়নি এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা)ও তা কখনো কল্পনা করতে পারেননি। প্রকৃতপক্ষে, ‘অজ্ঞ মুসলমান' কথাটি মুসলমান পদবাচক সংজ্ঞার পরিপন্থী বা বিপরীতার্থক । ইসলামের গৌরবময় দিনে একজন দরিদ্র মুসলিমের মত একজন অজ্ঞ মুসলিমকে খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর ছিল।


[৪]
আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলের শিক্ষাব্যবস্থারই ঈষৎ পরিবর্তিত রূপমাত্র। এ পদ্ধতি যে নিছক অকাজের তা বলছি না। কিন্তু এটি যে একমাত্র মোক্ষম পদ্ধতি- এ ভ্রান্ত ধারণাই আমাদের ক্রমাগত ধ্বংসে দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের যেভাবে শিক্ষাদেব, সেভাবেই তারা গড়ে উঠবে এবং সেভাবেই তাদের বুদ্ধির বিকাশ ঘটবে। তাই আজকের শিক্ষাপদ্ধতি যদি আমরা ঢেলে সাজাতে না পারি তাহলে জাতির উন্নতি নেই ।

আমাদের দেশের দুরবস্থা আজ চরমে পৌঁছেছে। সে দুরবস্থা পরিমাপের চেষ্টার লক্ষণ কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সেই মানুষও নেই। সকলেই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। জাতির এ ভয়ানক গ্যাংগ্রিনের অবস্থাটা তুলে ধরতেও সবাই ভয় পাচ্ছে। কিন্তু এ দুর্দশার কারণ কী? আমাদের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে কি কোন মহাপুরুষের জন্ম হয়নি, কোন বিরাট ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেনি? তবে আজ এ অবস্থা কেন? এর আসল কারণ কি এ নয় যে, আমাদের শিক্ষার মূলেই গলদ রয়েছে? যে শিক্ষা আমরা দেই, তাতে প্রকৃত মানুষ তৈরি হতে পারে কিনা, এ কথাটা আমরা ভেবে দেখেছি কি? বাইবেলে যে বলা হয়েছে : Domen gather grapes of thoms, or figs of thistles? - কাঁটার বোঝা থেকে কি আঙ্গুর পাওয়া যায়, না ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গুল্ম থেকে ডুমুর পাওয়া যায়?- এ কথাটি আমাদের জন্য আজ সর্বতোভাবে প্রযোজ্য।

সকল দেশের সকল মনীষী একথা স্বীকার করেছেন যে, ছাত্রদের চরিত্র গঠনের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। বস্তুতঃ চরিত্র গঠনই হচ্ছে শিক্ষার অন্যতম প্রধান গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আবার একথাও অস্বীকার করা যায় না যে, প্রযুক্তি, ভেষজ ও চিকিৎসা বিদ্যাসহ জ্ঞান বিজ্ঞানের সবগুলো শাখায় আমাদের জ্ঞানের দুয়ার খুলে দিতে হবে। কৃষি শিল্প কোন কিছুকেই অবহেলা করে নয় বরং এদের বেশি গুরুত্ব দিয়ে, কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করে সৎ ও দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে।

চরিত্র গঠনের জন্য চাই নৈতিক শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষা। আমাদের প্রাচীন শিক্ষা পদ্ধতিতে দুটো ভাগ স্বীকার করা হতো। একটি পরাবিদ্যা অপরটি অপরাবিদ্যা। পরাবিদ্যা শাখায় শিক্ষা দেয়া হতো ধর্ম আর মোক্ষ। আর এতে তাদের চরিত্র গঠন সহজতর হতো। এখন শিক্ষার এ দিকটি হয়ে পড়েছে গৌণ।

আমাদের ব্যক্তিত্বের দুটি aspect বা বিধার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এক apperant বা ‘প্রাতিভাসিক’ বিধা; দুই Real বা ‘সত্য’ বিধা। যেসব বিজ্ঞানে জ্ঞানের পরিধির প্রসার ঘটে, সেসব পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের বিষয় প্রাতিভাসিক বা apperant বিধায় বিধৃত। আর ইন্দ্রিয়তীত যে ‘প্রজ্ঞা’ মানুষকে জীবাত্মা, মানবাত্মা ও পরামাত্মার সম্পর্ক নির্ণয়ে উদ্বুদ্ধ করে, তার পরিচর্যা যে বিধায় বিধৃত তাকেই বলা হয়েছে ‘সত' বা Real বিধা। একে ‘সজ্ঞা’ নামেও অভিহিত করা যায়। ইন্দ্ৰিয়াতীত বলেই এ বিধাটি পঞ্চইন্দ্রিয় গ্রাহ্য নিরীক্ষা বহির্ভূত। প্রত্যেকের মধ্যে যে পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত অন্তর্লীন প্রকৃত সত্তা বা ‘সজ্ঞা’ রয়েছে তারই স্বরূপ বিধৃত আত্মার পরিচর্যায়। মানুষ তার এই ভাব সত্তার সঙ্গে যত বেশি যুক্তি হয়ে ভাব বিনিময় করে, ততই তার অভিজ্ঞতা পূর্ণতর হয়।

শিক্ষার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন : মানুষের অন্তর্নিহিত পূর্ণতার বিকাশ সাধনাই শিক্ষা। আন্তর সত্তার পূর্ণ বিকাশ সাধনই আমাদের শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য হওয়া উচিত। আত্মার আন্তর সত্তার স্বরূপই পূর্ণতা। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলেই দেখা যাবে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) নিরক্ষর হওয়া সত্ত্বেও ‘সম্পূর্ণ শিক্ষা' অর্জন করেছিলেন। আর বলতে পারি, সাক্ষর হওয়া সত্ত্বেও আমরা ‘অশিক্ষিত'। আমাদের অসম্পূর্ণ শিক্ষা এবং তার অপপ্রয়োগই আমাদের যাবতীয় দ্বন্দ্ব বিসস্বাদ ও দুঃখ ভোগের কারণ । আমাদের এই অসম্পূর্ণতার ত্রুটি রয়েছে বলেই বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় ‘প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ' তৈরি হয় না।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার গুণাগুণ সম্বন্ধে নানা মুনির নানা মত দেখা যায়। শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্গঠনের জন্য বিগত অর্ধ শতাব্দী ধরে বিভিন্ন কমিটি ও কমিশন গঠিত হয়েছে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এসব প্রচেষ্টার একমাত্র লক্ষ্য বহিরঙ্গ শিক্ষাক্রমের সংস্কার ও পূনর্গঠনের সামান্য চেষ্টা মাত্র। ব্যক্তিগতভাবে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া এ পর্যন্ত কোন কমিটি বা কমিশন আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মূলে ‘গলদ আদর্শহীনতা' বা ‘লক্ষ্য ভ্রষ্টতা’ সম্বন্ধে আলোচনা করেননি। প্রায় সকলেই কেবলমাত্র বৈষয়িক জ্ঞান, ধর্মনিরপেক্ষ বোধ বা অপরাবিদ্যার ওপরই জোর দিয়ে থাকেন। তাঁদের কেউই পরাবিদ্যা সম্বন্ধে সচেতন নন, অথবা বলতে পারি, সে সম্বন্ধে অবজ্ঞা বা উপেক্ষা প্রদর্শন করেন। তাই তার কথা উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না। ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য কেবল জীবিকা অর্জনের উপযোগী প্রশিক্ষণ দেয়ার মধ্যে সীমিত হয়ে পড়ে। অথচ একথা সকল কালের সকল মনীষী একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, পরাবিদ্যাহীন শিক্ষা মানব জীবনের প্রকৃত শিক্ষা বলে আখ্যায়িত হতে পারে না । এরূপ শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তি যত বিদ্বানই হোন না কেন, ‘প্রকৃত শিক্ষার’ অধিকারী বলে স্বীকৃতি পেতে পারেন না।

বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার ‘শিক্ষণ’-এর ‘ধারণ’ ‘মনন' বা মানসিকতার উৎকর্ষের প্রতি কোন প্রকার নযর দেয়া হয় না। এ শিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্যান, একাগ্রতা, নৈতিক পবিত্ৰতা পালনের মাধ্যমে মানসিক সংস্কার সাধন করে বিদ্যা অর্জনের যোগ্য পাত্ররূপে তৈরি করার কোন চেষ্টাই নেই। আগের দিনে বিদ্যালয় ছিল অনুকূল পরিবেশে। নগরের কোলাহলের ডামাডোলের মধ্যে মনমানসিকতার স্থৈর্য ও ধ্যানশীলতা বিনষ্ট হয় । কাজেই দৃঢ়ভিত্তিক বোধশক্তি সম্পন্ন জীবন তৈরি করার যথাযোগ্য পরিবেশের কথাও চিন্তা করার একান্ত প্রয়োজন রয়েছে।

আগের দিনে শিক্ষা সমাপনী উৎসবে ওস্তাদ উপদেশ দিতেন: বাবা, সবেমাত্র শিক্ষার দোর গোড়ায় পৌঁছেছো। এখনও রত্ন ভাণ্ডারের সন্ধান পাওনি। এখনই প্ৰকৃত শিক্ষার শুরু হলো। জীবনে একে ছাড়বে না, জীবন সংগ্রামে এ শিক্ষাই তোমার অবলম্বন। এ তোমাকে বিপদ থেকে বাঁচাবে, এ তোমাকে দুনিয়ার শান্তি দান কররে এবং আখিরাতে নিয়ামত পাওয়ার সহায়ক হবে। অতএব বিদ্যার্জন ছাড়বে না। বিদ্যালয় ছেড়ে যাচ্ছ, ব্রহ্মচর্য ছেড়ে যাচ্ছ, তাই বলে অধ্যয়ন ও শিক্ষার শেষ নেই। গার্হস্থ্য ধর্মে প্রবেশ করেছ, শিক্ষা ও অধ্যয়নই তোমার পাথেয়। উপদেশ হলো: তুমি মানুষ হও । উপনিষদ বলেছেন : সত্যংবদ ধর্মচর-সত্যকথা বলবে ও ধর্মচারণ করবে। সত্য থেকে বিচ্যুত হবে না, নিন্দনীয় কাজ করবে না । মঙ্গলজনক কাজ করবে । ইহসান করবে। এসব ধর্ম পালন করবে।

অবশ্যই শ্রদ্ধাদি গুণের অনুশীলন করবে। শাস্ত্রবাণীতে ও গুরুর কথায় যদি শ্রদ্ধাবোধ না করে থাক তবে জীবনে কোন ধর্মই করা হয় না। শাস্ত্র বলে : শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানম— যার শ্রদ্ধাবোধ আছে সেই জ্ঞান লাভ করতে পারে। আর যার শ্রদ্ধাবোধ নেই, তার ইহ-বা পরকাল কোন কালই নেই। গীতা বলে : অশ্রদ্ধাবানচ বিনশ্যতি শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি বিনাশ হয়।

শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সংযমের অনুশীলনী করা। আত্মশক্তির বোধন ও নিয়ন্ত্রণ শিক্ষা করা এবং যাবতীয় প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রেণে রাখার শিক্ষণই সারা জীবনের কর্মপন্থা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়। কলসের তলায় যদি একটি মাত্র ফুটো থাকে, তাহলে পানি যতই ভর্তি করি না কেন, তা বেরিয়ে যাবে। একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের অনিয়ন্ত্রণের কারণে যাবতীয় তপস্যা ও কৃচ্ছ্র সাধনা বরবাদ হয়ে যায়। জীবন নৌকা যদি আসক্তি রজ্জুতে বাঁধা থাকে তবে সারা জীব দাঁড় বেয়েও এগুনো যাবে না; দেখা যাবে যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি। যাবতীয় শ্রম বিফল হয়েছে।

চিত্ত বিশুদ্ধ করার শিক্ষণই অনুশীলন করতে হবে। হৃদয় হৃদের পানিতে যদি বাহ্য সংসারের তুফানে ঢেউ জাগে তবে তাতে আপন চেহারার সুষ্ঠু প্রতিবিম্ব দেখা যায় না। উর্মি ভেঙ্গে খণ্ডিত প্রতিচ্ছায়া সামগ্রিকতায় প্রতিভাত হয় না। আবার কেবল পানি স্থির থাকলেই চলবে না, স্বচ্ছ ও নির্মল হতে হবে। পাপ পঙ্কিলতা থেকে ধুয়ে মুছে নিজেকে পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে করতে হবে, তবেই তো তার ছবি পুরোপুরি দেখতে পাব। বাইরের বিশ্বের আলোড়ন ও আবিলতা-ধূলিময়লা-এ দুই উপাদান দূর করে নিজেকে শান্ত সমাহিত ও পাকসাফ করে সাধনায় নিয়োজিত হতে হবে। অনেকে বলেনঃ সালাত- সিয়াম-তপজপ-তসবিহ তাহলিল কি করে করব; ভোগের চঞ্চলতা সব সময় অন্তর অস্থির করে রাখে, মোহ হৃদয় আচ্ছন্ন করে ফেলে, আল্লাহতে মনোযোগী হওয়া যায় না। মন কেবলি ছুটাছুটি করে। স্মরণ রাখতে হবে যে, পার্থিব চঞ্চলতা ও মোহমায়া দূর করার জন্যই তো আরাধনা সাধনা, সালাত-দোয়া সবকিছু। বলা হয়েছে : আসসালাতু মি'রাজুল-মুমিনীন-সালাত মুমিনের মি'রাজ। আল্লাহ জান্নাত-জাহান্নাম- এসব স্পষ্টতর হবে, সামনে প্রত্যক্ষ হবে। অবিরাম অনুশীলনীর মাধ্যমে বাসনার লয়, ভোগের অবসান ও ত্যাগের মহিমার বোধন হয়। তাতেই অন্তর পরিচ্ছন্ন ও তৎচিন্তায় লীন হয়। এ-ই প্রকৃত শিক্ষার অনুশীলনীর অঙ্গ হওয়া উচিত।

একদিকে স্রষ্টা ও পালনকর্তার স্মরণ, অপরদিকে শয়তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, এ-ই তো মুমিনের জীবন। গীতায় বলা হয়েছে: তম্মাৎ সর্বেষু কালেষু মামনুস্মর যুধ্যচ-অতএব সর্বদা আমাকে স্মরণ কর এবং যুদ্ধ কর। এ-ইতো প্রকৃত জিহাদ। একবার একদল মুজাহিদ জিহাদ থেকে ফিরছিল, হযরত মুহাম্মদ (সা) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন: তোমরা কোত্থেকে এসেছো। তারা জবাবে বললো : জিহাদ থেকে। তিনি বললেন ছোট জিহাদ থেকে তোমরা বৃহত্তর জিহাদে এলে। অর্থাৎ জীবন সংগ্রামই বৃহত্তর জিহাদ। সেখানে যে জিহাদ করতে পারে, সে-ই প্রকৃত মুজাহিদ, সত্যিকার মুমিন।

জীবনের এই অনুশীলনী যে শিক্ষায় অনুপস্থিত সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ। অতএব সে শিক্ষা মানব জীবনের সাফল্যের সহায়ক নয়। তাই এ শিক্ষা কাম্য হতে পারে না। আমাদের সব শিক্ষার মূলে থাকবে এমন অনুশীলনীর পরিচর্যা যাতে ঈমান ও আকিদার পরিপোষণে জীবনের সব চিন্তা ও কর্ম হবে নিয়ন্ত্রিত। আর এ শিক্ষাই জাতির জীবনে এনে দিতে সক্ষম হবে সাফল্যের সোনার কাঠি।

জ্ঞানের সাধনায় নিয়োজিত হয়ে প্রতিটি মুসলিম, তথা মানুষ তার নিজের ও আর সবার অপশক্তির বিরুদ্ধে, অজ্ঞতা মূর্খতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে এবং তাতেই জ্ঞান, বিজ্ঞান, দর্শন, কলা, শিল্প তথা জ্ঞানের সকল শাখায় মুসলিম মানব কল্যাণে ইতিবাচক অবদান রাখতে পারবে বলে আশা করা যায়। আর একাজ সম্পন্ন হবে যে শিক্ষায়, সে শিক্ষাই হওয়া উচিত আমাদের সবার জন্য। শিক্ষিত, শিক্ষক, শিক্ষার্থী তথা সমাজের সকল স্তরের মানুষের কল্যাণ বয়ে আনবে যে শিক্ষা, সে শিক্ষাই প্রবর্তিত হওয়া উচিত শিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত, কামার, কুমার, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পী, চাকরিজীবী সবার জন্য যে শিক্ষা সুপারিশ করা যায়, তা-ই হলো মৌল শিক্ষা, সর্বজনীন শিক্ষা। তাতে যেমন ধর্ম থাকে, তেমনি থাকবে পার্থিব জীবনের চলা প্রশিক্ষণ। আর এ শিক্ষা যখন সমাজের সর্বস্তরের প্রতিটি মানুষের দেহ ও মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, মন, মস্তিষ্ক, চিন্তা ও কর্ম নিয়ন্ত্রণ করবে, কেবল তখনই আমরা আশা করতে পারি শ্রেষ্ঠ জ্ঞানবান আদর্শ নাগরিকের।


নির্দেশিকা :
১. কাজী দীন মুহম্মদ, মানব জীবন, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ: ১৩।
2. TS Eliot, Notes Towards the Definition of Culture, London, ১৯৪৮, P99 ff.
৩. M. M. Pickthol, Islamic Culture, উদ্ধৃত্ত- শাহেদ আলী, সম্পাদিত, ইসলামী সংস্কৃতির রূপরেখা, ঢাকা ১৯৬৭, পৃ: ২৫।
৪. কাজী দীন মুহম্মদ, জীবন সৌন্দর্য, ঢাকা, ১৯৮৪, পৃঃ ১৭৩ ।
৫. স্বামী বীরেশ্বরনন্দ, শিক্ষা ও ধর্ম প্রসঙ্গ, উদ্দীপনা, রামকৃষ্ণ স্মরণিকা, ঢাকা, ১৯৮৪ পৃ: ২৫।


লেখক: বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তাবিদ

‘কর্মহীন শিক্ষা যেমন অবাস্তব,
ধর্মহীন শিক্ষা তেমনিই অমার্জনীয়।
কর্ম শিক্ষা মানুষকে বাঁচাতে শেখায়।
কিন্তু ধর্মশিক্ষা মানুষকে যোগ্য নাগরিক
রূপে বাঁচতে ও চিন্তা করতে শিখায়’
                                 - ড. কাজী দীন মুহাম্মদ