ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য - ড. এম. এ. সালেহ
শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কোন কিছু বলতে গেলে প্রথমেই জানতে হবে পৃথিবীতে মানবজাতির আগমনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী ছিল। এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন শিক্ষাব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় না। পবিত্র কোরআনের মাধ্যমে মানব সৃষ্টির পরিকল্পনা, মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা করা সম্ভব। মানুষ সৃষ্টির পরিকল্পনা করে মানুষের মর্যাদা সম্বন্ধে মহান আল্লাহ ফিরিশতাদের কাছে তাঁর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। পৃথিবীতে মানুষকে তাঁর প্রতিনিধি হিসাবে প্রেরণ করার কথা ব্যক্ত করে মহান আল্লাহ বললেন, ('হে রাসূল) স্মরণ করুন সে সময়কে যখন আপনার প্রভু ফেরেশতাদেরকে (পরামর্শচ্ছলে) বললেন : আমি অবশ্যই জমিনে আমার প্রতিনিধি তৈরি করতে যাচ্ছি। ফেরেশতারা উত্তরে বললেন : আপনি সেখানে কি এমন কাউকে প্রতিনিধি বানিয়ে পাঠাতে চাচ্ছেন, যে সেখানে কেবল ফেতনা ফাসাদ আর খুনাখুনিই করবে। আমরাইতো আপনার প্রশংসার সাথে গুণকীর্তন করছি আর পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি (প্রভু) তাদের জবাবে বললেন : নিশ্চয়ই আমি যা জানি তোমরা তা জান না।' (আল কোরআন ২: ৩০-৩১)
মানুষের সৃষ্টি ও তার মর্যাদা সম্বন্ধে যে খবর মহান আল্লাহর এই বাণী হতে প্রকাশিত হয়েছে সেই বিষয়ে একটু চিন্তা করা আবশ্যক। উপরোক্ত আয়াতে লক্ষ্য করা যায় যে, মহান আল্লাহ মানুষকে মানুষ না বলে তাঁর ‘প্রতিনিধি' বলে উল্লেখ করেছেন। প্রতিনিধি শব্দটির মর্মার্থ বহুমাত্রিক এবং এর তাৎপর্য অসীম। মানুষকে প্রতিনিধি বানিয়ে মহান আল্লাহ মানুষকে যেমন মর্যাদার চরম শিখরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তেমনি তার ওপর অর্পণ করেছেন অপরিসীম দায়িত্ব । সেই দায়িত্ব নেহাত মানুষের খেয়াল খুশি অনুসারে সম্পাদন করা যাবে না। এটাই স্বাভাবিক যে, মানুষ পৃথিবীতে প্রতিনিধি হিসাবে একমাত্র আল্লাহর নির্দেশ ও হেদায়েত অনুসারেই জীবনের সকল কর্মকাণ্ডও পৃথিবীর সকল সমস্যা সমাধানে বাধ্য থাকবে। এই দায়িত্ব ও কর্তব্য যে কত গুরুতর দুরূহ তা পবিত্র কোরআনের নিচের আয়াত থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি।
আমরা সমস্ত আকাশ, পৃথিবী ও পর্বতসমূহকে এই গুরু দায়িত্ব বহন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু এরা কেউই এই দায়িত্ব গ্রহণ করতে রাজি হয় নাই। বরং তারা এতে অত্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছিল। কিন্তু মানুষ এই গুরু দায়িত্ব বহন করতে রাজি হয়েছিল।' (আল কোরআন ৩৩:৭২)
উপরোক্ত আয়াত হতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, আকাশ ও পৃথিবীর অপরিসীম বিশালত্ব অথবা পাহাড় পর্বতের দৃঢ়তা ও অটলতা সত্ত্বেও এই দায়িত্বভার গ্রহণ করতে তারা অস্বীকৃতি জানাল। এতে আরও পরিষ্কার ভাবে বুঝা গেল যে, মহান আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্বভার কত ব্যাপক ও কত গুরুতর।
আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব করতে হলে চাই আল্লাহর সৃষ্ট পদার্থের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা এবং তাকে মানব জাতির কল্যাণে ব্যবহার করা। আল্লাহ মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করে সেই কাজ সাধ্যমত সম্পন্ন করার জন্য মানুষকে আল্লাহ সৃষ্ট পদার্থের উপর খবরদারি করার কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন - ‘এবং তিনি (আল্লাহ) তোমাদেরই অধীনস্থ করেছেন, যা কিছু আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে আছে। খেয়াল কর, এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য রয়েছে গভীর মর্মবাণী।' (আল কোরআন ৪৫:১৩)
এখন স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, মহান আল্লাহ কিভাবে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই মানুষের অধীন করে দিলেন? আসলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রতম এটম হতে অসীম মহাবিশ্ব আল্লাহর প্রদত্ত বিধান আল্লাহরই নির্দেশে অভাবনীয় নিয়মানুবর্তিতার সঙ্গে মেনে চলে। আর মানুষ যা করতে পারে তা হলো, আল্লাহর সেই বিধানগুলি অক্লান্ত সাধনার মাধ্যমে এবং আল্লাহর ইচ্ছায় উদঘাটিত করা। এইভাবে সৃষ্টি হয়েছে বিজ্ঞান এবং আল্লাহর বিধান সমূহ উদঘাটন করার মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি বিজ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করে চলেছে অবারিতভাবে। আর এই বিধানগুলি যেহেতু অপরিবর্তনীয় ও অলংঘনীয়, তাই এইগুলো অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রয়োগ করা যায়। এই প্রায়োগিক দিকটাকেই আমরা এখন প্রযুক্তি বা Technology বলে থাকি। এই বিষয়ে মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন ‘আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে-সবই আল্লাহর জন্য। এবং এরা আল্লাহর বিধান সমূহ অপরিসীম সতর্কতার সঙ্গে মেনে চলে।' (আল কোরআন ২:১১৬) মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করে তাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে পৃথিবীতে জীবন অতিবাহিত করার জন্য ছেড়ে দেন নাই। বিশেষ দয়াপরবশ হয়ে মানুষকে তাঁর (আল্লাহর) প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতাও দিয়েছেন মানুষের মধ্যে খোদায়ী গুণাবলি দিয়ে। আল্লাহ বলেছেন- ‘আমি মানুষকে সুষম অবয়ব প্রদান করেছি এবং তার অভ্যন্তরে আমার রূহ ফুকে দিয়েছি।' (আল কোরআন ১৫:২৯)
আল্লাহ বিশেষ রহমতে শুধমাত্র মানুষকেই এই রুহ ফুৎকার করেছেন, যার ফলে মানুষকে পরিণত করা হয়েছে আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এবং মানুষ অর্জন করেছে অসীম সম্ভাবনা। তবে এই সম্ভাবনা বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে চাই জ্ঞান বিজ্ঞানের অক্লান্ত সাধনা, যার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহপ্রদত্ত সুপ্ত শক্তিকে উজ্জীবিত করতে পারে, তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন হয়ে সুষ্ঠুভাবে তা সম্পন্ন করে দুনিয়া ও আখেরাতের চরম উন্নতি সাধন করতে পারে।
শিক্ষার মাধ্যমে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জন করতে হবে তার দর্শন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্ব, তার প্রচার, প্রসার ও সংরক্ষণের মূলমন্ত্র মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআন এইভাবে বলেছেন, ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি সব কিছুই সৃষ্টি করেছেন। যিনি ‘আলাক’ থেকে মানুষ সৃষ্টি করেছেন। পড়, এবং তোমার প্রভু অতীব দয়াময়। যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দান করেন। তিনি মানুষকে সে সবও জানান, যে সব সে জানত না।' (আল কোরআন ৯৬ : ১-৫)
হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় আমাদের প্রিয় নবী (সা) যখন স্রষ্টার ধ্যানে গভীর ভাবে নিমগ্ন, ইসলামের সেই উষালগ্নে মহান আল্লাহ উপরোক্ত পাঁচটি আয়াত জিবরাইল (আ:) মারফত প্রেরণ করে পবিত্র কোরআনের সূচনা করেন। এই আয়াত কয়টি মূলতই তাওহীদভিত্তিক জ্ঞান বিকাশের এক বিপ্লব সাধনের আহবান। কোরআনের এই রূপ জ্ঞান বিজ্ঞান ভিত্তিক আয়াতগুলি দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং রাসূল করিম (সা) এর জ্ঞান বিজ্ঞান অর্জনের সর্বোচ্চ তাগিদের ফলে জাহিলিয়াতে নিমজ্জিত আরব জাতি দ্রুততম সময়ের মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে যে চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন বিজ্ঞানের ইতিহাসে তা কিংবদন্তি হয়ে আছে।
এই আয়াতগুলি একটু মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করলে নিম্ন লিখিত বিষয়গুলি প্রতিভাত হয়:
(ক) এই পাঁচটি আয়াতের মধ্যে পাঠ করার কথা তিনবার বলা হয়েছে। রাসূল (সা) এর অক্ষর জ্ঞান ছিল না। তিনি পড়তে পারেন না বলা সত্ত্বেও মহান আল্লাহ তাঁকে বার বার পাঠ করার আদেশ দিয়ে অধ্যয়ন করার অপরিসীম গুরুত্বের কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
(খ) যে যুগে ভ্রূণ-বিজ্ঞান (embriology) সম্বন্ধে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না তখন মহান আল্লাহ ‘আলাক' শব্দটির দ্বারা ভ্রূণ-বিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্বের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
(গ) মানুষের জন্যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল শাখাই তাওহিদের ভিত্তিতে গড়তে হবে। তাওহিদশূন্য বা তাওহিদবিরোধী কোন কিছুই মানুষের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারবে না।
(ঘ) মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে শান্তি ও সমৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে গেলে আল্লাহ রহমত লাভ করবেই।
(ঙ) কলমের সাহায্যে শিক্ষাদান তথা লিখনের মাধ্যমে মানুষের লব্ধ জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্থায়ীভাবে রক্ষা করাও তার প্রচার ও প্রসারের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
(চ) শিক্ষার্থী হয়ে মানুষ নিজেদের চেষ্টা চালিয়ে গেলে তাদের অজানা বস্তু কিছুই আল্লাহ তাদেরকে জানিয়ে দেন বিধায়-জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনা ছেড়ে উদাসীনভাবে জীবন কাটিয়ে দেয়ার কোন অবকাশ ইসলামে নেই।
উপরের এই কয়টি আয়াত পবিত্র কোরআনে জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত অসংখ্য আয়াতের সামান্য অংশ মাত্র। বস্তুত পবিত্র কোরআনের প্রায় এক-অষ্টমাংশ জুড়ে রয়েছে জ্ঞান- বিজ্ঞান অর্জনের জন্য মহান আল্লাহর তাগিদ। রাসূলে করিম (সা:) এই তাগিদের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেন জ্ঞান বিজ্ঞান অর্জনের প্রতি।
এই প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত আলোচনায় ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের প্রতি সামান্য দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে মাত্র। প্রকৃত পক্ষে কোরআন ও হাদিসে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ব্যাপারে অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে। এখন যেটা প্রয়োজন তা হলো, এই সব আয়াত ও হাদিস গভীরভাবে পর্যালোচনা ও গবেষণার মাধ্যমে ইসলামের আলোকে সার্বজনীন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে, যা সমগ্র মানবজাতির জন্য সামগ্রিক কল্যাণ বয়ে আনবে।
লেখক: অধ্যাপক, রসায়ন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।