আমাদের শিক্ষানীতি প্রণয়ন আদর্শিক ভিত্তি ও জাতীয় মূল্যবোধ - আব্দুল মান্নান তালিব
শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়। কিন্তু শুধু কি মেরুদণ্ড? মেরুদণ্ড মানুষকে দাঁড় করিয়ে রাখতে সাহায্য করে। শিক্ষাও জাতিকে দাঁড় করিয়ে রাখে। এই সঙ্গে তাকে জীবনীশক্তি সরবরাহ করে । তার জীবনের সমস্ত কাজে প্রেরণা ও উৎসাহ যোগায়। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে তাকে পথের দিশা দেয়। কাজেই এই অর্থে শিক্ষাকে জাতির প্রাণশক্তি বলা যায়।
জাতি ও মুসলমানদের জাতীয়তা: এ প্রসঙ্গে জাতির চেহারাও সুস্পষ্ট হওয়া দরকার। জাতি বলতে আমরা কী বুঝি? শুধু কি এক ভূখণ্ডে যারা বাস করে তারা এক জাতি? অথবা এক ভাষায় কথা বলে একই বর্ণ ও গোত্রের সাথে সংযুক্ত যারা তারা এক জাতি? এগুলো সবই একটা জাতির উপাদান সরবরাহ করে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ উপাদানগুলো এমন নয় যা একটা জাতিকে চিরকাল জীবনশক্তি সরবরাহ করে যেতে থাকবে। একই ভূখণ্ডে বাস করে, একই ভাষায় কথা বলে এবং একই বর্ণের অধিকারী হয়েও আদর্শিক কারণে জাতির একজন সদস্য নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে পারে। মানসিক দিক দিয়ে ভূখণ্ডগত এবং ভাষা ও বর্ণগত বিষয়কে সে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করতে পারে। একথা অবশ্যই মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করে তার বাইর জগৎকে। কাজেই জাতি গঠনের সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে আদর্শ ও মতবাদ যার ভিত্তিতে তার সমগ্র জীবন গঠিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। মুসলমানের জাতীয়তা ও প্রসঙ্গে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও মৌলিক বিষয়।
জাতীয়তা বিষয়ে যখন মুসলমানদের প্রশংসা আসে তার আদর্শ, মতবাদ ও ধর্ম তথা ইসলাম যা তার কেবল মনোজগৎ নয়, তার সমগ্র জীবন ও জীবনের সমস্ত কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে সবার ওপরে স্থান লাভ করে এবং তার স্থায়ী ভূখণ্ড, ভাষা বর্ণগত জাতী- য়তা দ্বিতীয় পর্যায়ভুক্ত বা পরিপূরক হয়ে যায়। কারণ ইসলামের সাথে মুসলমানদের অস্তিত্ব জড়িত, ভূখণ্ড ভাষা বর্ণ গোত্রের সাথে নয়। মুসলমান যদি ইসলামের অনুসারী না হয়, যদি অন্য কোনো মতবাদের অনুসরণ করে অথবা আংশিকভাবে ইসলামকে মেনে চলে অর্থাৎ ইবাদত-বন্দেগির ক্ষেত্রে আল্লাহর ইবাদত করে, রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করার সময় সেক্যুলার গণতন্ত্র বা অন্য কোন চরম ধর্মবৈরী মতবাদের রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারী অর্থনীতি গড়ে তোলার সময় ইসলামের ভারসাম্য পূর্ণ ন্যায়বাদী নীতিকে পুরোপুরি পুঁজিবাদ বা অন্য কোনো হালকা সমাজতান্ত্রিক ও জন কল্যাণমূলক নীতি অনুসরণ করে, তাহলে সে মুসলমান থাকতে পারে না। তখন সে হয় নিছক স্থানীয় ও সংকীর্ণ জাতীয়তার সাথে জড়িত একজন মানুষ। কাজেই মুসলমানকে যদি মুসলমান হিসাবে উপস্থাপন করতে হয় তাহলে তার আদর্শ, ধর্ম ও ইসলামকে পুরোপুরি গুরুত্ব দিতে হবে।
আদর্শ ও নীতিহীনতা: আমাদের এই স্বাধীন দেশটিতে স্বাধীনতার তিরিশ বছরেও কোনো সুস্পষ্ট শিক্ষা নীতি গড়ে ওঠেনি। অর্থাৎ সরকারি পর্যায়ে জাতি গঠনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দুশ' সোয়া দুশ' বছর আগে বৃটিশ শাসনামলে এখানে একটা শিক্ষানীতি তৈরি করা হয়েছিল-উদ্দেশ্য ছিল তাঁর শাসক জাতির শাসন কাজে সহায়তা করা, যারা বাহ্যিক চেহারা সুরাতে হবে ভারতীয় কিন্তু মন মর্জি ইংরেজদের। আমরা বলতে পারি এই ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার সামনে একটা উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল এবং তাতে তারা শতকরা একশ ভাগ সফলকাম হয়েছিলো। এই শিক্ষাব্যবস্থার বাড়তি লাভ হচ্ছে এই যে, তাদের তৈরি করা মানসিক ইংরেজদের হাতেই তারা দেশের শাসনভার স্থানান্তর করতে পেরেছে। এ শাসকদের অবহেলা ও অনিচ্ছাই মূল্যবোধের ভিত্তিতে গড়ে তোলার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিয়েছে। এর ফলে স্বাধীনতার তিন দশক পরও বাংলাদেশের বারো কোটি দেশের সামগ্র জনসমাজ পঙ্গত্বের শিকার হয়েছে। বিজাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার হীনতম লক্ষ্য জাতীয় মানসে সে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে তার ফলে শিক্ষিতের হার বাড়ানোর ব্যাপারে সাধারণ গণমানুষের মধ্যে কোনো স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ সৃষ্টি হচ্ছে না।
শিক্ষা কাকে এবং কেন?
শিক্ষার ক্ষেত্রে এখানে সেই আসল প্রশ্নই এসে যায়। অর্থাৎ শিক্ষা কাকে দেয়া হবে? কেন দেয়া হবে? সকল শিক্ষাব্যবস্থার পেছনে এ দুইটি হচ্ছে মূল প্রশ্ন। এ প্রশ্ন দুটির সঠিক জবাবই একটা জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষা দেয়া হবে বাংলাদেশের গণমানুষকে। এদেশের শতকরা পঁচাশি থেকে নব্বই ভাগ মুসলমান এবং দশ থেকে পনের ভাগ অমুসলমান। শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এই মুসলমানদের জন্য এবং অমুসলমানদের জন্যও। তবে এই শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা যাবে না যাতে তা অমুসলমানদের উপযোগী হয় কিন্তু মুসলমানদের জন্য হয়ে অনুপযোগী। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে মুসলমান ও অমুসলমানকে একাকার করা যাবে না। কারণ এটা একটা জাতি গঠনের প্রশ্ন। এ ধরনের প্রশ্ন যেখানেই অমুসলমানের প্রাধান্য চলে এসেছে এবং মুসলমানকে কোণঠাসা করে ধীরে ধীরে অমুসলমানের অধীন করা হয়েছে। এ উপমহাদেশে বাদশাহ আকবরের দীন ইলাহী এর একটা বড় প্রমাণ । আকবর দীন ইলাহীর মাধ্যমে যে সর্বজনীন ধর্মীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন তার মধ্যে ইসলামকে পুরোপুরি কোণঠাসা, বিকৃত ও বিলীন করা হয় কিন্তু অন্যদিকে অনৈসলামিক ইসলাম বিরোধ ও শেকীয় ভাবধারার সবকিছুই যথাযথভাবে সংস্থাপিত হয়। দুনিয়ার মতবাদ হচ্ছে দুটি। ইসলাম ও কুফর। ইসলাম হচ্ছে আল্লাহকে মেনে চলা এবং কুফর আল্লাহকে মানে না। আল্লাহর ব্যাপারে সংশয় পোষণ করা যেমন কুফরী তেমন আল্লাহর হুকুম কিছু মানা না মানাও প্রায় সমান ফলাফল উৎপাদন করে । যেমন সূরা বাকারার ৮৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে 'তোমরা কি কিতাবের [আল কুরআন] কিছু অংশ বিশ্বাস করো এবং কিছু প্রত্যাখ্যান করো? তোমাদের যারা এরূপ করে তাদের একমাত্র প্রতিফল পার্থিব জীবনে হীনতা এবং কিয়ামতের দিন তারা কঠিনতম শাস্তিতে নিক্ষিপ্ত হবে। ইসলাম কুফরের কোনো প্রকার আবেশ বা আমেজ অস্বীকার করে। বরং কুরআনে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে — — হে মুমিনরা-ইসলামে প্রবেশ করো সম্পূর্ণরূপে। [বাকারা : ২০৮] সূরা আল ইমরানের ১৯ আয়াত এর চাইতেও আরো এগিয়ে বলা হয়েছে ‘আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দ্বীন ও জীবন ব্যবস্থা।' অর্থাৎ ইসলাম ছাড়া অন্যকোনো জীবনবিধান ও জীবনব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। আল ইমরানের ৯৫ আয়াতে এ কথাটিই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। এ হিসাব ইসলাম ছাড়া বাকি সবই কুফর। কাজেই ইসলাম তার নিজস্ব পথে চলবে এবং কুফর চলবে তার নিজের তৈরি করা পথে। কুফরের পথে ইসলামকে চালানো নৈতিকতা, গণতান্ত্রিক রীতি ও ইসলামী বিধানের পরিপন্থী।
এখানে প্রশ্ন দেখা দেয়, একই দেশে দু'রকম ব্যবস্থা গড়া কি উচিত এবং সম্ভব? এ প্রশ্নের জবাবটি আসলে শিক্ষাব্যবস্থা কেন? এ প্রশ্নের জবাবের মধ্যে খুঁজলে মনে হয় সঠিক হবে। কারণ মুসলমানকে তো কোনোক্রমেই কুফরির দিকে নিয়ে যাওয়া যাবে না। তবে কুফর যারা চায়, যারা আল্লাহর অনুগত থাকতে চায় না তাদের সমৃদ্ধি ও পরিপুষ্টি শিক্ষাব্যবস্থার মূল কাঠামোর মধ্যে সম্ভব কিনা সেটাই বিচার্য বিষয়। এবার আমরা আসতে পারি দ্বিতীয় প্রশ্নে অর্থাৎ কেন শিক্ষা দেয়া হবে? শিক্ষার উদ্দেশ্য দুটি। এক ব্যক্তি ও ব্যক্তির আত্মিক পরিগঠন ও উন্নয়ন। দুই জাগতিক ও বৈষয়িক যোগ্যতা সৃষ্টি ও তার বিকাশ।
শিক্ষার প্রথম উদ্দেশ্য: প্রথম উদ্দেশ্যটি সম্পর্কে বলা যায়, শিশু তার জন্মের পর থেকেই প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে শিক্ষা লাভ করতে থাকে। সৃষ্টি সূচনা থেকেই আল্লাহ তার মধ্যে এই যোগ্যতা ও চাহিদা তৈরি করে দিয়েছেন । তার ইন্দ্রিয়গুলোকে সেইভাবে সংবেদনশীল করা হয়েছে। সে চোখ দিয়ে দেখে এবং মস্তিষ্ক দিয়ে তা অনুভব ও বিচার করে। কান দিয়ে শোনে এবং মস্তিষ্ক দিয়ে তা বিচার-বিশ্লেষণ করে। তা দিয়ে স্পর্শ করে এবং সঙ্গে সঙ্গেই মস্তিষ্কে তা ছড়িয়ে পড়ে এবং তাকে জানিয়ে দেয়। মুখ দিয়ে সে কথা বলে। তার মস্তিস্ক তার বিশ্লেষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সময় এগিয়ে চলার সাথে সাথে এবং তার মধ্যে পার্থক্য করতে শেখায়। এভাবে ধীরে ধীরে তার শিক্ষার পরিবেশ ও পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে থাকে। প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে শিক্ষালাভের এ পর্যায়ে মৃত্যু পর্যন্ত চলতে থাকে।
এই সঙ্গে শুরু হয় বাইরে থেকে পরিকল্পিতভাবে তাকে শিক্ষিত করে তোলার পর্ব। এই পর্বে বাপ-মা-ভাই বোন-আত্মীয়-স্বজন সবাই শামিল হন। একই সাথে পরিকল্পিত শিক্ষার সবচেয়ে বড় আয়োজন বিষয়গুলো যদি শিশুর ইতঃপূর্বেকার প্রকৃতি ও পরিবেশের স্বাভাবিক শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যশীল হয় তাহলে তার শিক্ষা পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয়। কারণ নবী সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘কালু মাওলুদিন ইউলাদু আল্লাহ ফিতরাতিল ইসলাম ফা আবওয়াইহ ইউহাইবিদানাহ ওয়া ইউমাজ জিসারনাহু ওয়া উইউনাসইসরহ।' অর্থাৎ প্রত্যেক নবজাতক আল্লাহর সৃষ্টি ইসলামি প্রকৃতির ওপর জন্মলাভ করে, তারপর তার বাপ-মা তাকে ইহুদি, অগ্নিপূজারী ও খ্রিষ্টান বানায়।
অর্থাৎ তার মধ্যে আল্লাহ সৃষ্ট যে ইসলামি প্রকৃতি থাকে তার বাপ মা সে অনুযায়ী তাকে শিক্ষা দিলে সে হয় মুসলিম। আর তার বাইরে শিক্ষা দিলে তারা তাকে আল্লাহ বৈরী অমুসলিমে পরিণত করে। এভাবে বাইরে শিক্ষা তা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র পরিবেশে। পরিবেশও বিপর্যস্ত হয়। ধীরে ধীরে ভারাক্রান্ত হয় এলাকা, দেশ ও পৃথিবী। এতবড় বিপর্যয় থেকে নিজের এলাকা, দেশ ও সমগ্র পৃথিবীকে রক্ষা করার দায়িত্ব মুসলমানের। মুসলমানকে এমন শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা তার অভ্যন্তরের প্রাকৃতিক শক্তি ও সামর্থ্যগুলোকে বিকশিত ও পরিপুষ্ট করবে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যা তাকে একজন প্রকৃত মানুষ ও আল্লাহর বান্দায় পরিণত করবে। এমন একজন মানুষ যে হবে মানবতার সকল গুণে গুণান্বিত, যার মধ্যে মানবিক সততা, সৎ বৃত্তি ও নৈতিকতা চরম বিকাশ লাভ করবে এবং অসবৃত্তি ও নীতিহীনতা যার ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারবে না। যে হবে মানবতার বন্ধু, তার শত্রু নয়। পৃথিবীকে ও পৃথিবীর মানুষকে যে নিজের স্বার্থ ও উন্নয়নের হাতিয়ার মনে করবে না বরং সবার উন্নয়ন ও স্বার্থ অর্জনের সহায়ক হবে।
এভাবে ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা ব্যক্তি মানুষের অভ্যন্তরীণ প্রাকৃতিক চাহিদাকে সমগ্র সৃষ্টির ও বিশ্ব প্রাকৃতিক চাহিদার সাথে সামঞ্জ্যশীল করে। যার ফলে একজন মানুষ হয় সমগ্র মানবতার জন্য কল্যাণকর । মানুষের সমাজে বিপর্যয়ের সমগ্র পথ রুদ্ধ হয়ে যায় । মানুষ প্রকৃত মানুষে পরিণত হয়। ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা এমন কোনো পদ্ধতি অবলম্বন করবে না যার ফলে মানুষের ব্যক্তিত্বের বিনাশ হবে এবং একজন মানুষ তার কিছু বা সমস্ত মানবিক গুণাবলি বিসর্জন দিয়ে আংশিক বা পূর্ণ অমানুষে পরিণত হবে। এভাবে ব্যক্তির মধ্যে আল্লাহ যে প্রাকৃতিক গুণাবলি সৃষ্টি করে দিয়েছেন ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে তা বিকশিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করবে।
শিক্ষার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য: ব্যক্তির আত্মিক উন্নয়নের মাধ্যমে শিক্ষার প্রথম লক্ষ্যার্জনের সাথে সাথে তার মধ্যে জাগতিক ও বৈষয়িক যোগ্যতা সৃষ্টি এবং তাকে বিকশিত ও লালন করাই হচ্ছে শিক্ষার দ্বিতীয় উদ্দেশ্য।
এ পৃথিবীতে মানুষ নিজের প্রচেষ্টায় আসেনি। কিন্তু এখানে তাকে নিজের প্রচেষ্টায় বেঁচে থাকতে হবে। তাকে বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে হবে। পৃথিবীতে তাকে নিজের রিযিক সংগ্রহ করতে হবে। এ রিযিক আল্লাহ তার জন্য তৈরি করে রেখেছেন। আল্লাহ বলেন ‘পৃথিবীতে বিচরণকারী সকলেরই রিযিক বা জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহরই।' [হুদঃ ৬]-এ রিযিক বা জীবিকা কী? জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা সবই রিযিকও জীবিকা। তা কেবল অর্থনৈতিক নয় বরং সব ধরনের প্রয়োজন। এ প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা ও সরঞ্জাম আল্লাহ তৈরি করে রেখেছেন। মানুষকে তা সংগ্রহ করে নিতে হবে।
শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে মানুষ জানতে পারে আসলে তার কী প্রয়োজন, কতটুকু প্রয়োজন এবং কিভাবে তা অর্জন করতে হবে। তারপর কিভাবে তাকে ব্যবহার করতে হবে এটাও এর সাথে জড়িত। কারণ অর্জন করা হয় ব্যবহার করার জন্য। তাছাড়া এটা হচ্ছে দুনিয়ার একটা সম্পদ আর এ দুনিয়ার এই সম্পদকে কুরআন মাতা বলা হয়েছে। মাতা অর্থ হচ্ছে ভাগ্য সম্পদ যার পরিমাণ অতি সামান্য। অর্থাৎ এ সম্পদ তৈরি করা হয়েছে মানুষের ভোগ করার জন্য।
সম্পদ যেমন নানা প্রকার তেমনি, যোগ্যতাও নানা পর্যায়ের। এই বিভিন্ন মুখ্য যোগ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ হবে শিক্ষাব্যবস্থা লক্ষ্য। এ ক্ষেত্রে মুসলিম-অমুসলিমদের বিভেদ দেখা দেবে না। এই যোগ্যতার উন্মেষ ও বিকাশের ধারাও এগিয়ে চলবে আত্মীয় উন্নয়নের পথে। অর্থাৎ একজন একজন আদর্শ মানুষ এবং আল্লাহ একজন অনুগত বান্দা তার শারীরিক শক্তি-সামর্থ্য বুদ্ধিবৃত্তি ও মেধা ব্যবহার করে পৃথিবীর বুকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত রাখবে। শিক্ষাব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যাতে মানুষ জানবে কোন সম্পদটি তার প্রয়োজন এবং কোনটির প্রয়োজন নেই? কোন পরিমাণ জানলে সম্পদের অপচয় ও বিনষ্ট হবার সম্ভাবনা কমে যায়। আর কেন প্রয়োজন একথা জানতে পারলে সম্পদের যথাযথ ব্যবহার সম্ভব হয়। অযথা ব্যবহার পথ বন্ধ হয়ে যায়। আল্লাহ দায়িত্ব নিয়েছেন মানুষসহ পৃথিবীর জীবনী শক্তির অধিকার সমস্ত প্রাণীর রিযিক ও জীবিকার। অর্থাৎ সবার রিযিক লাভের ব্যবস্থাপনা তিনি তৈরি করেছেন। সেই অনুযায়ী বুদ্ধি বিবেচনা শক্তির অধিকারী মানুষ ও জিন ছাড়া সমস্ত প্রজাতি রিযিক লাভ করছে। মানুষকে এই পদ্ধতি জেনে নিতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা এই পদ্ধতি সম্পর্কে মানুষকে সজাগ করবে। এর ফলে প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার সাথে মানুষের ব্যবস্থাপনা সামঞ্জস্যশীল হবে এবং বিশ্বে ও মানুষের জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে না। শিক্ষাব্যবস্থার এটি একটি মহৎ লক্ষ্য।
শিক্ষানীতি প্রণয়নে ইসলামী আদর্শ অপরিহার্য
আমাদের এই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে স্বাধীনতার তিন দশক পরও জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে ইংরেজের গোলামির তকমা গলায় পরে এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা কতটা লজ্জাজনক তা দেশপ্রেমিক চিন্তাশীল ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করবেন। একটি অতি ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু স্বার্থে একটি সেকুলার শিক্ষাব্যবস্থার বোঝা মাথায় নিয়ে জাতিগতভাবে নীতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা। আসলে আমরা নিজেদের মুসলিম জাতিসত্তার কোনো যৌক্তিক ভিত্তিই থাকবে না। বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তার সাথে আমাদের মুসলমানিত্ব জড়িত একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। যেমন হিন্দুস্তানের স্বাধীন সত্তার সাথে প্রত্যেকটি হিন্দুস্তানি হিন্দুতার হিন্দুত্বকে জড়িত করেছে। হিন্দুত্বকে বাদ দিয়ে তারা কেবলমাত্র বাঙ্গালি, বিহারী, মারাঠী, রাজপুতানী ইত্যাদি হিসাবে হিন্দুস্তানি থাকতে রাজি নয়। তেমনি আমরা বাংলাদেশের মুসলমানের মুসলমান হিসেবেই বাংলাদেশী। আর যেখানে আমরা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে আমাদের ধর্মীয় ও জাতীয় চেতনাকে আড়াল ও উপেক্ষা করা জাতি হিসেবে আমাদের মৃত্যুর চক্রান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
কাজেই আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে আমাদের ইসলামী আদর্শ ভাবধারা, মূল্যবোধকে ভিত্তিভূমি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তাহলে জাতিগতভাবে আমাদের উন্নতি ও বিকাশ সম্ভবপর হবে। কারণ বাংলাদেশের কোনো একজন মুসলমানও তার মুসলমানিত্ব বাদ দিয়ে জীবিত থাকতে রাজি হবে না। এক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে তার ওপর সেক্যুলার বা ধর্মহীনতাবাদ আরোপ করে কোনো লাভ হবে না কেবল তাকে পিছিয়ে দেয়া ছাড়া। আর ইসলমী আদর্শ ও মূল্যবোধ আমাদের শিক্ষাকে পিছিয়ে দেবে না। বরং বিশ্বের অন্যান্য সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার তুলনায় অনেক এগিয়ে দেবে। কারণ এর মধ্যে জাগতিক যাবতীয় উন্নতি, প্রগতি ও অগ্রগতিকে ধারণ করার যেমন ক্ষমতা ও যোগ্যতা আছে তেমনি নিজস্বভাবে এর অগ্রগতির নিজস্ব যোগ্যতা আছে যা অন্যদের নেই।
লেখক: সাহিত্যিক, অনুবাদক, পরিচালক-বাংলা সাহিত্য পরিষদ।