মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট ২০২২

ইসলামী আন্দোলন ও রাজনীতি- রেদওয়ান রাওয়াহা

ইসলাম আল্লাহ প্রদত্ত এক নির্ভেজাল জীবন বিধান। ইসলামের পরিচয়ে আল্লাহ রব্বুল আলামীন তাঁর কালামে পাকে ইরশাদ করেন-


اِنَّ الدِّیۡنَ عِنۡدَ اللّٰہِ الۡاِسۡلَامُ-
অর্থাৎ ‘ নিশ্চয়ই আল্লাহর কাছে ইসলামই একমাত্র দ্বীন। (সূরা আল ইমরান : ১৯)
আমরা জানি, আল্লাহর দেয়া এই ইসলাম, এই জীবন বিধানে কোনো খুঁত নেই। ঘাটতি নেই। এটা পরিপূর্ণ। পবিত্র কালামে হাকিমে আল্লাহ সুবহানাহু ওতা’আলা বলেন,
اَلۡیَوۡمَ اَکۡمَلۡتُ لَکُمۡ دِیۡنَکُمۡ وَ اَتۡمَمۡتُ عَلَیۡکُمۡ نِعۡمَتِیۡ وَ رَضِیۡتُ لَکُمُ الۡاِسۡلَامَ دِیۡنًا ؕ فَمَنِ اضۡطُرَّ فِیۡ مَخۡمَصَۃٍ غَیۡرَ مُتَجَانِفٍ لِّاِثۡمٍ ۙ فَاِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ ﴿۳﴾ ‘
আজ আমি তোমাদের জন্য দ্বীনকে পূর্ণ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য একমাত্র দীন রূপে মনোনীত করলাম।’ (সূরা মায়িদা : ০৩)

এরপর আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদেরকে এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইসলাম ছাড়া যদি অন্য কোনো মত-পথ ও মতাদর্শ কিংবা তন্ত্রমন্ত্র আমরা খুঁজি, তবে আল্লাহর কাছে কস্মিনকালেও তা গ্রহণযোগ্য হবে না। যারা ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুতে শান্তি আর স্বস্তি চায়, তারা ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারেই পড়ে থাকবে। আল্লাহ তা’আলা বলেন-

وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
‘যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম সন্ধান করে, কস্মিনকালেও তা গ্রহণ করা হবে না এবং আখেরাতে সে হবে ক্ষতিগ্রস্ত ।’ (সূরা আলে ইমরান : ৮৫)।

প্রথম আয়াতটা খেয়াল করুন (সূরা আল ইমরান : ১৯), সেখানে আল্লাহ তাঁর মনোনীত দ্বীনের ক্ষেত্রে শুধু দ্বীন (دين) বলেননি। বলেছেন আদ-দ্বীন ( الدين)। دين অর্থ একটি পথ, একটি আইন, একটি দ্বীন-ধর্ম। আর আদ-দ্বীন (الدين) অর্থ পথটি বা আইন-বিধানটি। এখন কেউ যদি শুধু পথ বা আইন-বিধান বলে, তবে তা যেকোনো পথ, যেকোনো বিধান হতে পারে। আর যদি তা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়, তার মানে এই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথ একজন পথিকের জন্য নিরাপদ হতে পারেনা।

আরবি ব্যাকরণে মারেফা(معرفة) ও নাকেরা(نكرة)নামে একটা নিয়ম আছে। মারেফা মানে নির্দিষ্ট। নাকেরাহ মানে অনির্দিষ্ট। তো আল্লাহ দ্বীন (دين) শব্দটিকে নাকেরা না করে আলিফ লাম যুক্ত করে আদ-দ্বীন (الدين) বলে মারেফা করেছেন, তথা নির্দিষ্ট করেছেন। মানে আমাদের জন্যে এই একটি মাত্র দ্বীন। এই একটি মাত্র পথ। এই একমাত্র আইন বা বিধান।

দ্বীন এবং আদ-দ্বীনের মধ্যে পার্থক্য প্রসঙ্গে ইমাম মওদূদী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইংরেজি ভাষায় This is a way (এই একটি পথ)-এর পরিবর্তে This is the way (এ একমাত্র পথ) বলায় অর্থের দিক দিয়ে যতোখানি পার্থক্য সৃষ্টি হয়, ‘দীন’ (دين) এবং ‘আদ-দীন’ (الدين) শব্দের মধ্যেও অর্থের দিক দিয়ে ঠিক ততোখানি পাথর্ক্য হয়ে থাকে। অর্থাৎ কুরআন একথা বলছে না যে, “ইসলাম আল্লাহর নিকট একটি ( মনোনীত ) ধর্ম।” বরং তার দাবি, “ আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র প্রকৃত, বিশুদ্ধ ও নির্ভুল জীবনব্যবস্থা বা চিন্তা ও কর্মের প্রণালি।” (একমাত্র ধর্ম : পৃষ্ঠা -০৭)

যেহেতু এটাই আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র নির্ভুল জীবনব্যবস্থা, সেহেতু এছাড়া অন্যকোনো আইন, অন্যকোনো নিয়ম-পদ্ধতি, বিধি-বিধান সঠিক ও অনুসরণযোগ্য হতে পারেনা আমাদের জন্যে।

দ্বীন (دين) শব্দের অর্থ প্রসঙ্গেও সাঈয়েদ মওদূদী (রহঃ) চমৎকার একটা কথা বলেছন। তিনি বলেন, “দ্বীন হচ্ছে জীবন-যাপনের এমন পন্থা, যা মানুষের জীবনে অনুসরণ করা যেতে পারে।” আর ঠিক সে কারণেই আল্লাহ দ্বীনের (دين) সাথে আমাদের জন্য (পথ বা বিধি-বিধান হিসেবে) আল-ইসলামকে (الاسلام) নির্ধারিত করে দিয়েছেন। এবং এই ইসলামকেও শুধুই পথ হিসেবে না, একমাত্র পথ হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এখন দেখুন, যদি আল্লাহ তাআলা একমাত্র পথ হিসেবে ইসলামকে আমাদের জন্যে নির্ধারণ করে দেয়ার পরও কেউ অন্য পথে যায়, তবে তার সে যাওয়াটা নিরাপদ হবে না। হয়তো যেতেও পারে, তবে ঝুঁকি আছে। আর ঝুঁকির বিষয়াদি বাদ দিলেও আল্লাহ কিন্তু কোনো পথই রাখেননি আমাদের জন্য ইসলাম ছাড়া। আর সে কারণেই দ্বীনের (دين) সাথে আলিফ লাম যুক্ত করে আদ-দ্বীন ( الدين) বলেছেন। এবং সাথে জুড়ে দিয়েছেন আল-ইসলামকে (الاسلام)। মানে হলো এই একটিই পথ। এই পথ ছাড়া অন্য কোনো পথই নেই আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর আল্লাহর নির্দিষ্ট করে দেওয়া এই একমাত্র পথ ছেড়ে অন্য কোনো পথে যাবার চিন্তা করাটাই তো বোকামি আমাদের জন্য, কারণ এছাড়া আমাদের জন্য আর কোনো পথই রাখেননি তিনি। এখন আল্লাহর পথ ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করা মানেই বিপদ ডেকে আনা। ক্ষতিকে বরণ করে নেয়া। ক্ষতিগ্রস্তদের কাতারে পড়ে থাকা।

যেহেতু আল্লাহ রব্বুল আলামীন আমাদের জন্যে একমাত্র দ্বীন হিসেবে, জীবন চলার একমাত্র পথ হিসেবে ইসলামকে নির্ধারিত করেছেন, সেহেতু এরমধ্যে জাগতিক সবকিছুই আছে। জীবনে বাঁচতে হলে, চলতে হলে যা যা প্রয়োজন সব কিছুই এই ইসলামে আছে। আর ইসলাম ছাড়া অন্যকিছু অন্বেষণ করলে বা অবলম্বন করলে যেহেতু আমরা আমাদের চিরস্থায়ী আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবো, সেহেতু আমরা ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মতাদর্শকে গ্রহণ করতে পারি না, পারি না কখনোই অন্য কোনো বিধানের দিকে ঝুঁকে পড়তে। সেটা হোক রাজনীতির নাম করে, হোক তা জ্ঞানের নাম করে কিংবা সাহিত্য-সাংস্কৃতির নাম করে, অথবা সভ্যতা বিনির্মাণের নাম করে। আমাদেরকে সবকিছু ইসলাম থেকেই নিতে হবে, যেহেতু ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, আজ আমাদের মাঝে ইসলাম বিজয়ীর আসনে সমাসীন নেই। তা হোক সামাজিকভাবে, অথবা রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে, কিংবা অর্থনৈতিকভাবে; এক কথায় কোনোভাবেই এই দুনিয়ায় আল্লাহর দ্বীন কোথাও প্রতিষ্ঠিত নেই। এই অপ্রতিষ্ঠিত ইসলামকে পুনরায় পৃথিবীর জমিনে প্রতিষ্ঠিত করার মহান লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই দ্বীনের পরিপূর্ণ বুঝওয়ালা ঈমানদারেরা ইসলামী আন্দোলনে শামিল হয়। নিজেদের জীবনের মিশন এবং ভিশন হিসেবে আল্লাহর দেয়া আদ-দ্বীনকে গ্রহণ করে নেয়। এখন যেহেতু একা একা কোনো মতবাদকে, কোনো চিন্তাকে পূর্ণতা দেয়া যায় না, যায় না করা প্রতিষ্ঠা। সেজন্যেই আল্লাহর নির্দেশিত পন্থায় ইসলামী আন্দোলনের মহান মুজাহিদগণ সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ হয়।

ইসলাম যেমন ব্যাপক। ইসলামী আন্দোলনও এক ব্যাপক-বিস্তৃত চিন্তা-দর্শনের নাম। ইসলাম যতোটা ব্যাপক, ইসলামী আন্দোলনের পরিধিও ততোটাই ব্যাপক। ইসলামী আন্দোলন কোনো ক্ষুদ্র জাগতিক আন্দোলনের নাম নয়। ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠন বইতে আন্দোলনের সংজ্ঞায় শহীদ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (রহঃ) বলেন,
“প্রতিষ্ঠিত কোনো কিছুকে অপসারণ করে সেখানে নতুন কিছু কায়েম বা চালু করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা, প্রাণান্তকর চেষ্টা, তথা সুনিদির্ষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে পরিচালিত সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা বা সংগ্রাম সাধনার নামই আন্দোলন।”


এখন যারা জাগতিক আন্দোলনের পেছেন ছোটে, তারা হয়তো নির্দিষ্ট একটা বিষয়ের জন্যেই ছোটে। নির্দিষ্ট একটা লক্ষ্য পূরণের জন্যই তারা তাদের আন্দোলন পরিচালনা করে। সেই নির্দিষ্ট বিষয় হাসিল করার জন্যে নীতি-নৈতিকতা, বোধ-বিশ্বাস ও আদর্শকে পদদলিত করতেও কুণ্ঠিত হয় না। তারা কেউ হয়তো রাজনৈতিক মাঠে বিজয়ী হয়ে স্রেফ ক্ষমতার মসনদে সমাসীন হবার জন্যেই আন্দোলন করে। কেউ হয়তোবা অর্থনৈতিক বিষয়ের কোনো পাওনা বুঝে পাবার জন্যেই আন্দোলন করে। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা, জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর মুজাহিদগণ কখনোই কেবল দুনিয়াবী নির্দিষ্ট কোনো একটা বিষয়ে সফলতা পাবার জন্যে উদ্গ্রীব থাকে না। আবার কোনো একটা দিকে সফলতা পাবার পর ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা সীমালঙ্ঘনও করে না। এমনকি নির্দিষ্ট বিষয়ের পরাজয়েও মুষড়ে পড়ে না।

যাইহোক, ইসলামী আন্দোলন যেহেতু এক ব্যাপক-বিস্তৃত চিন্তা-দর্শনের নাম, ইসলাম যেহেতু পরিপূর্ণ এক জীবন বিধানের নাম, সে হিসেবে এটাতে রাজনীতিও আছে। তাই ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা রাজনৈতিক মাঠেও সক্রিয় থাকে কিংবা রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করে। তবে এই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কোনো প্রকার নীতি-আদর্শকে বিষর্জন দিয়ে করতে ইচ্ছুক হয় না সত্যিকারের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা। যেনতেনভাবে রাজনৈতিক মাঠে সফল হতে কিংবা ক্ষমতার মসনদেও যেতে চায় না তাঁরা। রাজনৈতিক জয়েও অতি উল্লাসে উদ্বেলিত হয়না। আবার পরাজয়ে হতাশও হয় না। অতি রাজনীতি করতে গিয়ে ইসলামকে গৌণ হিসেবে গ্রহণ করে না। কারণ তাঁরা রাজনীতিতে অংশগ্রহণই তো করে দ্বীনের স্বার্থে। দ্বীন বিজয়ের আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু রাজনৈতিক বিজয়ের জন্যে তাঁরা ইসলামী আদর্শ পরিত্যাগ করে না। করতে পারে না। করা উচিতও নয়।

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন কিংবা বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচির সর্বশেষ ধপা হচ্ছে রাষ্ট্র-ক্ষমতার রাজনীতি রিলেটেড। এরপূর্বেও চারটা বা তিনটা ধপা কিন্তু সরাসরি রাজনীতি রিলেটেড না। এর কারণ কী? কারণ হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য শুধু রাষ্ট্র-রাজনীতি বা ক্ষমতা নয়। ইসলামী আন্দোলনকৃত কাফেলাগুলো রাজনীতিকে দ্বীনের একটা অংশ মনে করে, এবং তাকে গুরুত্বপূর্ণ অংশই মনে করে। তবে তাঁরা রাজনীতেকেই একমাত্র দ্বীন মনে করে না। কিন্তু এর বাহিরে যাঁরা ভাবে, যেমন ইসলামী আন্দোলন থেকে জ্ঞানের আন্দোলনকে আলাদা করা, কিংবা রাজনীতিকে আলাদা করা, অথবা ধর্মকে আলাদা করা, বা এমন কথাবার্তা বলা যে — ধর্মে যেটা না-জায়েজ সেটা রাজনীততে জায়েজ বা করা যায় ইত্যাদি। এভাবে আর এরকম চিন্তা যে বা যারা করেন, তাঁরা ইসলামী আন্দোলন কতোটুকুন বুঝছেন, সেটা প্রশ্নই থেকে যায়। বিশেষত তাঁরা এটা ভাবতে পারেন —যাঁরা সংগঠনে ইসলামী আন্দোলনের সেন্সে এসেছেন, এসেছেন জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর দাসত্ব কবুল করে এবং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর জজবায় উদ্বেলিত হয়ে। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর বিষয়ে শহীদ মাওলানা নিজামী (রহ.) বলেন, “জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর সূচনা হয় মানব জাতির প্রতি আল্লাহর দাসত্ব কবুলের আহবান জানানোর মাধ্যমেই।” কিন্তু আমরা যদি ক্ষণিক এই দুনিয়ার জয়-পরাজয়ের দিকে চেয়ে রাজনৈতিক আদর্শ থেকে আল্লাহর দাসত্বের বন্ধন ছিন্ন করে ফেলি, তাহলে হয় আমি ইসলামী আন্দোলন বুঝিনি, নয়তো-বা বুঝেশুনে মুনাফিকি করছি, কিংবা আমাকে শেখানো এবং দেখানো আদর্শকে সচেতনভাবে জলাঞ্জলি দিচ্ছি। আল্লাহর বিধানের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছি। কারণ, ইসলামী আন্দোলনের ভাই-বোনদেরকে রাজনৈতিক দাওয়াত দিয়ে কিন্তু সংগঠনে সংঘবদ্ধ করেনি । তাঁদেরকে ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত দিয়েই সংগঠনের অধীনে সংঘবদ্ধ করা হয়েছে। তাঁদেরকে দাওয়াত দিয়েছে বা দেয়া হয়েছে ইমাম হাসান বান্নার (রহঃ) সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে। যেখান ইমাম বান্না রহিমাহুল্লাহ বলেছেন-

"আমরা তোমাকে ডাকছি ইসলামের সুমহান শিক্ষার দিকে,
ইসলামের অনন্য নির্দেশের দিকে,
ইসলামের শ্বাশ্বত বিধানের দিকে,
ইসলামের কল্যাণময় পথের দিকে,
যদি এটাকে তোমরা রাজনীতি মনে করো,
তবে এটাই আমাদের রাজনীতি।”

ইমাম হাসান আল-বান্না রহিমাহুল্লাহ আরো বলেন, “আপনাদের অন্তরের জগতে ইসলামের শাসনকে প্রতিষ্ঠা করুন, তাহলে আল্লাহ সারা পৃথিবীতে ইসলামীশাসন প্রতিষ্ঠিত করে দেবেন।”

তাহলে কী বুঝা গেলো? রাজনীতি হচ্ছে ইমাম বান্নার দৃষ্টিতেও ইসলামের একটি অংশ। যেভাবে ব্যক্তিগত ইবাদাত-আখলাক আর ইলম অর্জনও ইসলামের অংশ। সবকিছু মিলিয়েই ইসলামী আন্দোলন। শুধু রাজনীতির নাম-ই ইসলামী আন্দোলন নয়। আবার শুধু ইলম অর্জন করে বিরাট তাত্ত্বিক বনে যাওয়াটাও ইসলামী আন্দোলন নয়। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের এ-ও শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালীন সাফল্য অর্জনই ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। স্রেফ ক্ষমতায় যাওয়া, বা রাজনীতিকেই অতিরিক্ত প্রাধান্য দিয়ে তাতে সফল হওয়াটাই ইসলামী আন্দলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য নয়।

ইসলামী আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য যে আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং পরকালীন সাফল্য অর্জন; এই বিষয়ে দেখুন আল্লাহর কুরআন কী বলে-

يَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ وَيُدْخِلْكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ ۚ ذَٰلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমনসব বাগানে প্রবেশ করাবেন যার নীচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে। আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন। এটাই বড় সফলতা।’ ( সূরা সফ : ১২)

فَاسْتَبْشِرُوا بِبَيْعِكُمُ الَّذِي بَايَعْتُم بِهِ ۚ وَذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
‘কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনা-বেচা করছো সে জন্য আনন্দ করো। এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য।’ ( সূরা তাওবা : ১১১)

فَلْيُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ الَّذِينَ يَشْرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا بِالْآخِرَةِ ۚ وَمَن يُقَاتِلْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَيُقْتَلْ أَوْ يَغْلِبْ فَسَوْفَ نُؤْتِيهِ أَجْرًا عَظِيمًا

‘আল্লাহর পথে তাদের লড়াই করা উচিত যারা আখেরাতের বিনিময়ে দুনিয়ার জীবন বিকিয়ে দেয়। তারপর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে লড়বে এবং মারা যাবে অথবা বিজয়ী হবে তাকে নিশ্চয়ই আমি মহাপুরস্কার দান করবো।’ (সূরা নিসা : ৭৪)

রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি বা বিভিন্ন বিষয়াদিতে মিথ্যের ধ্বজাধারীদের উৎপাত প্রবলভাবে দেখা যায়। কিন্তু ইসলামী আন্দোলনের কর্মীরা সেসব দেখে ঘাবড়ে যায় না। তাঁরা তাঁদের নীতি-আদর্শকে বিষর্জন দিয়ে সেসবের পেছেন ছোটে না। ইমাম মওদূদী রহঃ-ও ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, 'মিথ্যার প্রাবল্য দেখে ঘাবড়ে যাবেন না, সে তো কখনো ঝড়ের বেগে আসে আবার বুদবুদের মতো বিলীন হয়ে যায়।'

এমনকি ইমাম মওদূদীও রাজনীতেকেই কেবল ইসলামী আন্দোলন মনে করেননি। তিনি তাঁর “দাওয়াত ও কর্মনীতি”
বইতে খুবই স্পষ্ট ভাষায় লিখেছেন —"নিছক একটা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই আমাদের উদ্দেশ্য নয়। প্রকৃতপক্ষে মানুষের সামগ্রিক জীবনে ইসলাম নির্ধারিত পরিপূর্ণ বিপ্লব সৃষ্টি করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।” তবে তিনি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার বিষয়ে সচেতন ছিলেন কেন? তা এই জন্য যে, যেন সমাজ থেকে ধীরে ধীরে খোদাদ্রোহী-অসৎ লোকজনের হাত থেকে মানুষের নেতৃত্ব খতম হয়ে যায়। তিনি যেনতেনভাবে ক্ষমতায় যাবার বিষয়ে কীরূপ ধারণা পোষণ করতেন, সেটা তাঁর রচিত
“ইসলামী রাষ্ট্র কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়” বইটাতে খুবই সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে।

বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের অন্যতম তাত্ত্বিক আলিম, শাইখ ইউসুফ আল-কারজাভীও কিন্তু ইসলামী আন্দোলন বলতে শুধু রাজনীতি বা রাজনৈতিক সফলতাকেই বোঝেন না। তিনি মনে করেন — “ ইসলামী আন্দোলন হচ্ছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামকে চালিকা শক্তি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার এক নিরন্তর কঠোর কর্মপ্রচেষ্টা।”

আমরা এই আন্দোলনে শামিল হবো কী জন্যে, একজন মুমিন ইসলামী আন্দোলনের এই মহান কাফেলায় নিয়োজিত হয়ে ময়দানে ভূমিকা রাখবে কী জন্যে, সে বিষয়টিও তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন। তিনি বলেন— “জীবনের সর্বস্তরে আল্লাহর কালাম যাতে সবার ওপর সমুন্নত হয়, সে লক্ষ্যে সে (একজন মুমিন) এই আন্দোলনে অবতীর্ণ হয়। আর এই প্রচেষ্টায়, এই সংগ্রামে, এই আন্দোলনে মুমিন বিজয়ীও হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। ( বই : আধুনিক যুগ : ইসলাম কৌশল ও কর্মসূচি, পৃষ্ঠা- ১৯-২০)

এই বিষয়টিই আবার ইমাম মওদূদীর চিন্তায়ও ফুটে ওঠে। তিনি তাঁর কর্মীদের এবং মুসলিম উম্মাহকে তাঁর রচিত “ইসলামী আন্দোলন : সাফল্যের শর্তাবলী” বইতে এই বিষয়ে খুবই স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ আল্লাহর। আমাদের কাজ হচ্ছে সেজন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। আর সেই চেষ্টাটা কেমন এবং কীরূপ হবে, তা-ও তিনি বলে দিয়েছেন উক্ত বইটাতে। মানোয়ন্নয়েনর সময় তো বইটা নোট করি। পড়ি। মুখস্থ করি। কিন্তু এরপর আমরা উক্ত বইটাকে ভালো করে চর্চায় রাখি তো?

যাই হোক, সর্বশেষ কথা হচ্ছে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের উচিৎ ইসলামী আন্দোলনেই দৃঢ়ভাবে টিকে থাকা। মিথ্যার ধ্বজাধারী রাজনীতিবিদদের প্রাবল্য দেখে ঘাবড়ে না গিয়ে নিজেকে ইসলামী আন্দলনের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে টিকিয়ে রাখাটাই হোক মূল টার্গেট। এরপর ইসলামী আন্দলনের প্রয়োজনে যদি আমাকে রাজনীতি করতে হয়, তাহলে আমরা যেন রাজনীতির ময়দানেই ভূমিকা রাখি। জ্ঞানের জগতে যদি বিদগ্ধ মুজতাহিদ হিসেবে গড়ে ওঠতে হয়, তবে যেন আমরা তা-ই করি। সমাজ-রাষ্ট্রে যদি ভূমিকা রাখতে হয়, তবে আমরা যেন একজন জাঁদরেল রাজনীতিবিদ হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারি। যদি সমাজ-সেবায় ভূমিকা রাখতে হয়, যদি প্রশাসন ও নেতৃত্বে ভূমিকা রাখতে হয়, যদি সাংস্কৃতিক ময়দানে কিংবা অর্থনৈতিক পরিম-লে অবদান রাখতে হয়, তবে আমরা যেন যার যার যোগ্যতানুযায়ী তা-ই করি। আমাদের মগজে এই একটা কথাই যেন গেঁথে থাকে যে, আমারা একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী। এরচেয়ে বেশি কিছু নয়। এর বাহিরে আমরা যা করবো, তা দ্বীন ও দ্বীনি আন্দোলনের প্রয়োজনেই করবো। সেটা হোক রাজনীতি বা অন্য কিছু।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক