রবিবার, ২৯ আগস্ট ২০২১

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গুম হওয়া ৪ শিবির নেতার সন্ধানের দাবীতে ছাত্রশিবিরের বিবৃতি।

 বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর গুম হওয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্র শিবির নেতা ওয়ালীউল্লাহ ও আল মুকাদ্দাস, রাজধানীর আদাবর এলাকা থেকে হাফেজ জাকির হোসেন ও যশোর বেনাপোল থেকে রেজওয়ান হুসাইনের সন্ধানের দাবীতে বিবৃতি প্রদান করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষ্যে এক যৌথ বিবৃতিতে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি সালাহউদ্দিন আইউবী ও সেক্রেটারি জেনারেল রাশেদুল ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কর্তৃক গ্রেপ্তারের পর গুম হওয়া সন্তানের জন্য পিতামাতা ও স্বজনদের প্রতিক্ষার প্রহর দীর্ঘ হলেও অমানবিক আচরণেই অটল রয়েছে প্রশাসন। ২০১২ সালে ফেব্রুয়ারির ৪ তারিখ ব্যক্তিগত কাজ শেষে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়াগামী হানিফ এন্টারপ্রাইজের ৩৭৫০ নাম্বার গাড়িতে ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে মধ্য রাতে গাড়ি থেকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দাওয়াহ এন্ড ইসলামী ষ্টাডিজ বিভাগের মেধাবী ছাত্র, ছাত্রশিবির ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক অর্থ সম্পাদক মো. ওয়ালীউল্লাহ এবং ফিকাহ বিভাগের মেধাবী ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক আল মুকাদ্দাসকে আশুলিয়ার নবীনগর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে গ্রেফতার করে। কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছর হয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত তাদের গ্রেপ্তারের স্বীকার করেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অন্যদিকে ২০১৩ সালের ২ এপ্রিল দিবাগত রাত ৪.০০ টায় সাদা পোশাকধারী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শ্যামলী রিং রোডের ১৯/৬ টিক্কাপাড়া, বাসা থেকে হাফেজ জাকির হোসেনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। ৮ বছর পেরিয়ে গেলেও তার কোন সন্ধান দেয়নি পুলিশ। একইভাবে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট দুপুর ১২টায় বেনাপোল পোর্ট সংলগ্ন দূর্গাপুর বাজার থেকে বেনাপোল পোর্ট থানার এসআই নূর আলমের উপস্থিতিতে দোকান মালিক কর্মচারীসহ অসংখ্য মানুষের সামনে থেকে গ্রেফতার করা হয় শিবির কর্মী রেজওয়ানকে। ৫ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু তারও কোন সন্ধান দেয়নি পুলিশ। তাদের গ্রেপ্তারের পর পরই পুলিশ ও প্রশাসনের বিভিন্ন অফিসে যোগাযোগ করা হয় এবং আমরা বিভিন্ন সুত্রে নিশ্চিত হই তাদেরকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফজতেই রাখা হয়েছে। তাদের উদ্ধারের জন্য আইন, আদালত ও মানবাধিকার সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থার দারস্ত হয়েছে তাদের স্বজনরা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই মেধাবী ছাত্রের গুমের ব্যপারে ২০১২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি আব্দুল আউয়াল ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ পুলিশের আইজিকে তলব করে দু’ছাত্র নিখোঁজ হওয়ার ব্যপারে তদন্তের অবস্থা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়। অন্যদিকে ৪ শিবির নেতার সন্ধানের দাবিতে ক্যাম্পাসে ধর্মঘট, মানববন্ধন, মিছিলসহ বিভিন্ন আন্দোলন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সরব প্রতিবাদ এবং হাইকোর্টের নির্দেশনার পর বছর পেরিয়ে গেলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গুম করা মেধাবী ছাত্রদের গ্রেপ্তারের কথা স্বীকার বা সন্ধান দেয়নি। উল্টো গুম হওয়া ছাত্রদের সন্ধান করতে গিয়ে তাদের মা-বাবা ও স্বজনদের পুলিশ কর্তৃক নানা হয়রানীর শিকার হতে হয়েছে। এখনো পর্যন্ত গুমের বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। কাউকে গুম করে দেয়া আন্তর্জাতিক আইনেও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে স্বীকৃৃত। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিকরা গুমের মতো সমাজবিরোধী, মানবতাবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী এই অমানবিক দুষ্কর্মের শিকার হচ্ছে। স্বাধীন দেশে যদি নিরপরাধ ছাত্রদের এভাবে গুম হতে হয়, আর তাদের উদ্ধারের প্রচেষ্টা চালালে যদি হয়রানির শিকার হতে হয় তাহলে জনগণ মনে করে এই স্বাধীনতা অর্থহীন। তাছাড়া একই কায়দায় রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আমান আযমী ও মীর আহমেদ বিন কাসেম।

নেতৃবৃন্দ আরও বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্মম কায়দায় গুম করার মাধ্যমে রাষ্ট্র ক্ষমতা ধরে রাখা এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের বর্বর পন্থা অবলম্বন করেছিলো নাৎসি বাহিনী। দূর্ভাগ্যবশত একবিংশ শতাব্দিতে জাতিকে এদেশে একই চিত্র দেখতে হচ্ছে। জাতিসংঘ ২০০৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ রচনা করে। এই আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়েছে ২১ ডিসেম্বর ২০১০ থেকে আর ২০১১ থেকে ৩০ আগস্ট গুমের শিকার ব্যক্তিবর্গের জন্য আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। কিন্তু বার বার আহবানের পরও বাংলাদেশ সরকার এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক এ সনদে স্বাক্ষর করেনি। এতেই প্রমাণ হয় সরকারের নাৎসিবাদী মনোভাবের প্রতিফলনই নির্বিচারে অব্যাহত গুমের রাজনীতি। শুধু ছাত্রশিবিরের ৪ জন নেতাকর্মী নয় বরং রাষ্ট্রীয় গুমের শিকার হন বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) আমান আযমী ও মীর আহমেদ বিন কাসেমসহ অনেকেই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তারের পর বহু ছাত্রসহ অনেকের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। গুম হওয়াদের মা-বাবারা আজও সন্তানদের ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। সহপাঠিরা তাদের ফিরে পাওয়ার আশায় প্রহর গুনছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের মেধাবী ছাত্ররা, নাগরিকরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে এমনভাবে গুম হয়ে যাবে তা কল্পনাও করা যায়না। এটা কোন সভ্য রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিফলন হতে পারেনা।

ছাত্রশিবির নেতৃবৃন্দ বলেন, অন্য সবার মত ওয়ালীউল্লাহ, মুকাদ্দাস, জাকির হোসেন, রেজওয়ান হুসাইন এদেশের সন্তান। সাংবিধানিক ভাবে তাদের ন্যায় বিচার পাবার অধিকার আছে। তাদের সাংবিধানিক অধিকার হরণের অধিকার সরকার বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নেই। যদিও আইনের ধারক বাহকরাই আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুই মেধাবী ছাত্রকে গুম করে রেখেছে। কোন সভ্য সমাজে এমন লোমহর্ষক আচরণ চিন্তা করা যায় না। এত কিছুর পরও আমরা বিশ্বাস করি ওয়ালীউল্লাহ, মুকাদ্দাস, জাকির হোসেন, রেজওয়ান হুসাইন আইনশৃঙ্খলা বাহীনির কাছেই নিরাপদে আছেন। গুমের শিকার ব্যক্তিরা কে কোথায় কিভাবে আছেন তা খুঁজে বের করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। অবিলম্বে তাদেরসহ গুম হওয়া সকলের সন্ধান দিতে হবে। একইভাবে তদন্ত কমিশন গঠন করে গুমের প্রত্যেকটি ঘটনার তদন্ত করে এর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। অন্যথায় গুমের সাথে সংশ্লিষ্টদের পরিচয় জাতির কাছে অজ্ঞাত নয়। সময়ের ব্যবধানে গুম হওয়া স্বজনদের আর্তনাদ আর চোখের পানির চরম মূল্য দিতে হবে সমাজবিরোধী, মানবতাবিরোধী ও রাষ্ট্রবিরোধী এই অমানবিক দুষ্কর্মের সাথে সংশ্লিষ্টদের।

নেতৃবৃন্দ এই অমানবিকতার অবসান ঘটিয়ে ৪ শিবির নেতাসহ গুম হওয়া সকল ছাত্র ও নাগরিকের সন্ধান এবং মুক্তি দিতে প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান।