বুধবার, ১৮ জুলাই ২০১৮

মুহাম্মদ আবদুল জব্বার

যে জীবন প্রেরণা জোগায়

৮ ফেব্রুয়ারি ২০১২। ইসলামী ছাত্রশিবিরের ফুটন্ত গোলাপের বাগান থেকে প্রস্ফুটিত দু’টি গোলাপ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বাছাই করলেন। আওয়ামী ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বর্বর নির্যাতনে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করলেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইল্লাইহি রাজিউন) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি চতুর্থ বর্ষের ছাত্র ও সোহরাওয়ার্দী হল শিবিরের সেক্রেটারি প্রিয়মুখ মাসুদ বিন হাবিব এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ও জীববিজ্ঞান অনুষদের প্রচার সম্পাদক সদাচঞ্চল মেধাবীমুখ মুজাহিদুল ইসলাম। 

বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয় সংঘর্ষ। নিষ্পাপ দু’টি তরুণ তাজা প্রাণকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও পুলিশের প্রহরায় নির্মম নির্যাতনের পর মৃত্যু নিশ্চিত করে ছাত্রলীগ। মুহুর্মুহু গুলি আর রামদা কিরিচ ও লাঠি-বৈঠার তাণ্ডবে আহত হয় আরো অনেকে। পুলিশ-ছাত্রলীগের দ্বিমুখী আক্রমণের পর ও সঙ্গী হারানোর সময় ক্ষোভে-বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন ছাত্র-জনতা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে চবি প্রশাসন বিনা সিন্ডিকেট বৈঠকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাস ও হল বন্ধ করে দেয়। 

বড় হওয়ার এক বুক আশা নিয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করে দেশ ও দশের সেবার স্বপ্ন! ডিজিটাল সন্ত্রাসের কাছে সব নিমিষেই চুরমার হয়ে গেল(!)। এই তাণ্ডবে প্রশ্রয়দানকারী শিক্ষকেরা শিক্ষক নামের কলঙ্ক। শিক্ষকের চেহারায় হিংস্র দানব। তারা সত্যকে সত্য বলতে পারেন না। ছাত্রলীগ-পুলিশের অমানবিক লাঠি-কিরিচের আঘাতে অনেকেই জখম। হাসপাতালে মুমূর্ষুদের নেয়ার জন্য বারবার অ্যাম্বুলেন্স চাইলেও আহতদের জন্য অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করতে না দিয়ে উল্টো প্রশাসন শিবির কর্মীদের ওপর হামলার জন্য ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহারের সুযোগ দেয়। ঘটনাস্থল থেকে খুনিদের গ্রেফতার না করে পুলিশ চবি শিবির সেক্রেটারি ও সংগঠনিক সম্পাদকসহ শিবির নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে। এ কেমন অমানবিকতা! মেধাবী দু’জন ছাত্র নিহিত হওয়ার ঘটনায় চবি প্রশাসনের কেউ এলো না হাসপাতাল অথবা মর্গে। সান্ত্বনা জানাল না কেউ নির্বাক সন্তানহারা মা-বাবাকে। কোথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? কোথায় তোমার চিরুনি অভিযান? মহাজোট সরকারের আইনশৃঙ্খলার ডিজিটাল উন্নয়ন একেই বলে! সরকারে এহেন কুরুচিপূর্ণ ভূমিকার কারণে শিক্ষাঙ্গনগুলো আজ সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। সবুর বাংলাদেশ! ডিজিটাল আওয়ামী লীগের পতনের জন্য ডিজিটাল ছাত্রলীগই যথেষ্ট।

সকল মিডিয়াতে শহীদ মাসুদ বিন হাবিব ও মুজাহিদুল ইসলামকে শিবিরের নেতাকর্মী হিসেবে উল্লেখ করে। তারপরও মুজাহিদকে ছাত্রলীগের কর্মী দাবি করে আবারও প্রমাণ করল লাশের রাজনীতি তাদের ঘৃণ্য রাজনীতিরই অংশ। নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা করতে গেলে দলীয় প্রশাসন উপরের নির্দেশ বলে তা গ্রহণ করেনি। পরদিন শহীদের পরিবার ছাত্রলীগের এ অন্যায় দাবিকে মিথ্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং মামলা না নেয়া ও চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার না করার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সাংবাদিক সম্মেলন করেন।

কী নির্লজ্জ! পুলিশ প্রশাসনের প্রকৃত খুনিদের বাঁচানোর কী ঘৃণ্য চেষ্টা! পরদিন ছাত্রলীগ বিশ্ববিদ্যালয় শিবির নেতৃবৃন্দকে আসামি করে থানায় হত্যা মামলা দায়ের করে। থানা এ মামলা সাদরে গ্রহণ করে। কী করে সন্ত্রাস বন্ধ হবে? যদি রাতের অন্ধকারে থানায় ছাত্র-খুনিদের নিয়ে ওসি বৈঠক করেন? বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। জীবনের নিরাপত্তা তো দূরের কথা, পুলিশ দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আপদের কারণ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

৯ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় দিন মর্গ থেকে শহীদের কফিন নেয়ার জন্য আত্মীয়স্বজনেরা এসেছিলেন। শহীদের সঙ্গী সাথীরা শেষবারের মতো দেখার এবং জানাজার নামাজ পড়ার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সমবেত হচ্ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগরীর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা শামসুল ইমলাম (এমপি) জানাজার নামাজ পড়ার জন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দিলে পুলিশ তাকে ঘিরে রাখে। জানাজার নামাজ পড়তে দিলো না। এ কেমন গণতন্ত্র! কেমন বর্বরতা!

পুলিশ প্রহরায় কফিন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। শহীদ মুজাহিদের বাড়িতে রওনা দিলাম। বাড়ির রাস্তায় পুলিশ টহল দিচ্ছে এবং যারা জানাজার নামাজের জন্য যাচ্ছেন তাদেরকে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। পুলিশের জিজ্ঞাসা- কোথায় যাচ্ছ? কেন যাচ্ছ? মুজাহিদ তোমাদের কী? এ কেমন নিলর্জ্জতা! উপরের নির্দেশের দোহাই দিয়ে শহরে জানাজার নামাজ পড়তে দিল না। এখন শহীদের বাড়িতে আসার পরও জানাজার নামাজ পড়তে দিচ্ছে না। প্রশ্ন জাগে তাদের কপালে কি জানাজা জুটবে?

জানাজার নামাজ বিকেল ৩টায় ঘোষণা করা হয়। পুলিশ বারবার শহীদ মুজাহিদের পরিবারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে থাকে, যাতে ২টার মধ্যে জানাজা শেষ করা হয়। হাজার হাজার মানুষ জানাজায় যোগ দেয়ার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে আসছিলেন। তাই শহীদের পিতা দৃঢ়তার সাথে পুলিশের এ অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ জানালেন। সমবেত জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়লেন। পুলিশ উপস্থিতির সংখ্যা সামাল দিতে না পেরে একদিকে অবস্থান নিলো।

পরে জামায়াত নেতা অধ্যাপক মফিজুর রহমান উত্তেজিত ও আবেগাপ্লুত আগত মুসল্লিদের নামাজে জানাজার আদব রক্ষা করতে বললেন এবং আল্লাহর জমিনে তার দ্বীন কায়েমের মাধ্যমে খুনের প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করেন। জানাজার নামাজ শেষে আমি শহীদ মুজাহিদের পিতার সাথে সাক্ষাতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আর চিন্তা করছিলাম, এ বেদনাক্লিষ্ট বাবাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবো। শহীদের পিতা কান্নাজড়িত কণ্ঠে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ছেলের নাম মুজাহিদুল ইসলাম রেখেছিলাম, আমার সন্তানকে আল্লাহ শহীদ হিসেবে কবুল করেছেন। আল্লাহর কাছে আমার সন্তানকে আমানত দিলাম। তার অনুভূতিতে আমি আশান্বিত হলাম। মনে মনে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম এবং বললাম, ইয়া আল্লাহ! তুমি তোমার এ গোলামদেরকে কবুল করো।

শহীদ মাসুদ বিন হাবিব ভাইয়ের গ্রামের বাড়িতে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানেও অনেক মুসল্লির আগমন ঘটে। কেউ অজোপাড়া এ গ্রামে ইতঃপূর্বে এত লোক কখনো একত্র হতে দেখেননি। জানাজার পূর্ব মুহূর্তে শহীদ মাসুম বিন হাবিব ভাইয়ের বাবা উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বলেন, আমার সন্তান কিছুদিন আগে ফেইসবুক স্ট্যাটাসে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছিল হে আল্লাহ তুমি আমাকে স্বাভাবিক মৃত্যু দান না করে শহীদি মৃত্যু দান কর। পরে আমি তার স্ট্যাটাসে আমিন লিখেছিলাম। আল্লাহ আমার ফরিয়াদ কবুল করলেন। আমার প্রিয় সন্তান মাসুদ বাতিলের আঘাতে শাহাদাতবরণ করলো। আমার চাইতে সৌভাগ্যবান পিতা কে হতে পারে? আল্লাহ সন্তানের ফরিয়াদও কবুল করলেন, আমার ফরিয়াদও কবুল করলেন। আলহামদুলিল্লাহ!

চবির শিবিরের নেতাকর্মীরা সম্মুখ যুদ্ধে দু’জন ভাইকে হারালো কিন্তু তারা নির্ভীকভাবে ময়দানে মোকাবেলা করল এবং পুলিশ-ছাত্রলীগের যৌথ উদ্যোগে হল দখলের চক্রান্ত দুঃস্বপ্নে পরিণত করল। তারা ঘোষণা দিল শুধু দু’জন নয়, আরো যদি লাশ হতে হয় কোনো আপত্তি নেই, পুলিশ-ছাত্রলীগকে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে চবি দখল করতে হবে। অবস্থা বেগতিক দেখে বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি সিন্ডিকেট বৈঠক ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। শিবির চাইলে চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের শায়েস্তা করতে পারত। কিন্তু ছাত্রশিবির হত্যার বদলে হত্যা করে প্রতিশোধ নিতে চায় না, রাসূল (সা)-এর আদর্শ মানব জীবনে প্রতিষ্ঠা করে বাতিলের ভিতকে দুর্বল করেই প্রতিশোধ নিতে চায়।

ছাত্রশিবিরেকে ক্যাম্পাসগুলো কেউ ভিক্ষা দেয়নি, শহীদদের রক্ত আর জীবনের বিনিময়ে তারা ক্যাম্পাস কিনে নিয়েছে। শিবির মৌসুমি পাখি নয়। ক্ষমতায় থাকলে ক্যাম্পাসে থাকবে আর ক্ষমতা চলে গেলে ক্যাম্পাস ছেড়ে দেবে- এটি একটি আদর্শবাদী দলের আচরণ হতে পারে না। বরং পরিস্থিতি যাই হোক না কেন পরিস্থিতি মোকাবেলা করেই মাঠে থাকতে হবে। আল্লাহ যুগে যুগে মর্দে মুমিনদের সাহায্য করেছেন, ভবিষ্যতেও সাহায্য করবেন। এটা আল্লাহরই ওয়াদা। লাখো তরুণেরা প্রিয় ক্যাম্পাসের জন্য দোয়া করে নির্ঘুম রাত কাটায়।

অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী আর শহীদের স্বজনেরা শিবিরের জন্য প্রাণ ভরে দোয়া করে আল্লাহর রহমত আর সাহায্য কামনা করে। শিবিরের আজ ৩৫(বর্তমানে ৪১) বছরে ঘাত-প্রতিঘাত মাড়িয়ে আত্মবিশ্বাস অর্জন করেছে, শিবির আল্লাহর রহমতের এক অফুরন্ত ফল্গুধারা। এত শহীদ, রক্ত, পঙ্গুত্ব ও নির্যাতনের দরিয়া পেরিয়ে আল্লাহর রহমত, মানুষের দোয়া, ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে শিবির তার লক্ষ্যপানে ছুটে চলছেই তীব্র গতিতে। আল্লাহ তুমি এ কাফেলাকে কবুল কর।


লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির