রবিবার, ১১ মার্চ ২০১৮

- ড. মোবারক হোসাইন

রক্তে রঞ্জিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহার চত্বর

“আমাদের কথাগুলোকে মুছতে চেয়েও বহুদিন
মুছে দিতে ওরা কেউ পারেনি
সত্যের কথা মোরা বলেই যাবো
বাঁধার পাহাড় যত মাড়িয়ে।”

১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠা লাভ করে। আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল সা. প্রদর্শিত বিধানকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠার ব্রত নিয়ে কাজ শুরু করে। তরুণ ছাত্রসমাজের কাছে তারা ইসলামের সুমহান আদর্শের কথা পৌঁছে দেবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে অহর্নিশ কর্তব্যরত রাখে নিজেদেরকে। তাদের প্রতিটি কাজ তরুণ ছাত্রদের হৃদয়ে ভালোবাসার স্থান করে নেয়। দিন দিন প্রিয় কাফেলায় ভিড়তে থাকে সচেতন ছাত্রসমাজ। প্রতিটি হৃদয়ে জেগে ওঠে সাহসের তুফান। উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে ভেঙে নির্মাণ করতে থাকে ঠিকানা। আর সেই ঠিকানায় এখন লক্ষ লক্ষ নাবিক। নাবিক বন্দরে পৌঁছানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষায় দুচোখের স্বপ্ন সমান এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই এই অগ্রযাত্রাকে নিস্তব্ধ করে দেয়ার জন্য শুরু থেকেই নানা বাধা ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে থাকে। সকল বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে ছাত্রশিবির এগিয়ে যেতে থাকলে বিরোধীরা নবীন সংগঠনটিকে কুঁড়িতেই নিঃশেষ করার জন্য বৃহৎ হত্যাকান্ড সংঘটিত করার পরিকল্পনা করে ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ইতিহাসে যে কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৮২ সালের ১১ মার্চের হত্যাকান্ড তার মধ্যে অন্যতম। এক নারকীয় লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ। সে এক হৃদয়বিদারক মর্মান্তিক ঘটনা যা কারবালার ইয়াজিদ বাহিনীর নৃসংশতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পরবর্তীতে অবশ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে আরো অনেক রক্ত ঝরেছে। শিবিরের বিগত প্রায় ৪১ বছরের ইতিহাসে সংঘটিত হয়েছে অসংখ্য ঘটনা। সেসব ঘটনাপ্রবাহে রয়েছে ২৩৪ জন শহীদের রক্তস্নাত শাহাদাতের নজরানা। কিন্তু ’৮২ সালের ১১ মার্চের ঘটনা ছিল শিবিরের ইতিহাসে প্রথম শাহাদাতের ঘটনা। তাই এ ঘটনাটি একদিকে যেমন শিবিরকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়, পথ চলার সাহস দিয়ে যায় প্রতিদিন। অন্য দিকে ইসলামবিরোধী শক্তির জঘন্য বর্বরতার সাক্ষ্য দেয় ইতিহাস। ইসলামপ্রিয় জনতার জন্য এক শোকাবহ দিন। ’৮২ সালের এ দিনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর লাল হয়েছিল ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের রক্তে। শাহাদাতের অমৃত সুধা পান করেছিলের চারজন শিবিরকর্মী; শাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার।

ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে
১৯৮২ সালের ১১ মার্চ ছাত্রশিবিরের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবীণবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। অনুষ্ঠানের তারিখ যতই ঘনিয়ে আসতে থাকে ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ ততই বাড়তে থাকে। আর বাতিল শক্তির প্রতিভূ সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীরা প্রাসাদ ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে। এমতবস্থায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে উৎখাত করার জন্য তারা নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে হামলা চালানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে ছাত্রশিবিরের দায়িত্বশীল ও কর্মীরা ১০ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নবীনবরণের প্রচারকার্য চালানোর সময় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীরা তাদের ওপর হামলা চালায়, এতে কয়েকজন শিবিরকর্মী আহত হয়। শিবির তাদের শত উসকানি ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করে।

ঘটনার দিন
১১ মার্চ সকাল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের আহবানে নবাগত ছাত্রসংবর্ধনা অনুষ্ঠান। এদিন সকাল ৮টা থেকেই প্রশাসনিক ভবনের পশ্চিম চত্বরে শিবিরের নবীনবরণের ডাকে সাড়া দেয় হাজার তরুণ-যুবকের দল। চারদিক থেকে শত শত ছাত্রশিবিরকর্মী গগনবিদারী শ্লোগান দিতে দিতে অনুষ্ঠানস্থলে আসতে থাকে। ছাত্রজনতার ঢল নামে নীল প্যান্ডেলের সম্মুখপানে। ৯টায় কুরআন তেলাওয়াতের প্রাণকাড়া সুমধুর বাণী দিয়ে নবীনবরণ শুরু হতে যাচ্ছে। হঠাৎ সাড়ে ৯টার দিকে পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরাও পাশের শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। তাদের হাতে ছিল হকিস্টিক, রামদা, বর্শা, ফালা, ছোরা, চাইনিজ কুড়াল ইত্যাদি ধারালো অস্ত্র। শিবিরের সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হলে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা বারবার অনুষ্ঠান পন্ড করার জন্য উসকানিমূলক কর্মকান্ড চালাতে থাকে। শিবির নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ধৈর্যের সাথেই সংঘর্ষ এড়িয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু তাদের টার্গেট তো ভিন্ন। শিবিরকে স্তব্ধ করে দিতে অনুষ্ঠানে হামলা চালানো-ই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। তথাকথিত বামচর্চার কেন্দ্রবিন্দু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের এ ধরনের বড় আয়োজন তারা কোনোভাবেই সহ্য করতে পারেনি। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী বিভিন্ন এলাকা থেকে বহিরাগত অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরাও শহীদ মিনারে সমবেত হতে থাকে। একপর্যায়ে নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে চতুর্দিক থেকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

শিবিরকর্মীরা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। পরবর্তীতে সন্ত্রাসীরা আবারো সংগঠিত হয়ে হামলা চালায়। দীর্ঘ সময় ধরে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলতে থাকে। এ সময় শহর থেকে ট্রাকভর্তি বহিরাগত অস্ত্রধারীরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সন্ত্রাসীদের সাথে যোগ দেয়। শুরু হয় আরো ব্যাপক আক্রমণ। সন্ত্রাসীদের আক্রমণের প্রচন্ডতায় নিরস্ত্র শিবিরকর্মীরা দিগি¦দিক ছোটাছুটি শুরু করে। আত্মরক্ষার জন্য শিবিরকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঘঈঈ ভবন ও কেন্দ্রীয় মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে। কিন্তু সেখানেও হায়েনাদের থাবা থেকে রেহাই পায়নি আমাদের ভাইয়েরা। সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা মসজিদ ও ইঘঈঈ ভবনে আশ্রয় নেয়া নিরীহ শিবিরকর্মীদের ওপর তারা পাশবিক কায়দার হত্যায় মেতে ওঠে। সন্ত্রাসীদের আঘাতে শহীদ শাব্বির আহমেদ মাটিতে লুটিয়ে পড়লে সন্ত্রাসীরা তার বুকের ওপর পা রেখে তার মাথার মধ্যে লোহার রড ঢুকিয়ে দেয় এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে সমস্ত শরীর। হাসপাতালে নেয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন। শহীদ আব্দুল হামিদ ভাইকে চরম নির্যাতনের সময় তিনি মাটিতে পড়ে গেলে সন্ত্রাসীরা একটি ইট মাথার নিচে দিয়ে আর একটি ইট দিয়ে মাথায় আঘাতের পর আঘাত করে তার মাথা ও মুখমন্ডল থেঁতলে দেয়; ফলে তার মাথার মগজ বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। রক্তাক্ত আব্দুল হামিদের মুখমন্ডল দেখে চেনার কোনো উপায় ছিল না। ১২ মার্চ রাত ৯টায় তিনি শাহাদাতের অমিয় পেয়ালা পান করেন। শহীদ আইয়ুব ভাই শাহাদাত বরণ করেন ১২ মার্চ রাত ১০টা ৪০ মিনিটে। দীর্ঘ কষ্ট ভোগের পর ২৮ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৪০ মিনিটে নিজ বাড়িতে চিরবিদায় গ্রহণ করেন শহীদ আব্দুল জব্বার ভাই। তাদের এ নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতা ভাষায় বর্ণনা করার মতো নয়। শিবিরকর্মীদের আর্তচিৎকার আর আহাজারিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠলেও কসাইদের পাষাণ হৃদয় এতটুকুও স্পর্শ করতে পারেনি। এ নরপশুরা দীর্ঘ সময় ধরে মৃত্যুর বিভীষিকা সৃষ্টি করলেও মাত্র কিছু দূরত্বে অবস্থানরত পুলিশবাহিনী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের কথা, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতেও এগিয়ে আসেনি। এমনকি আহত রক্তাক্ত মৃত্যুপথযাত্রী শিবিরকর্মীদের উদ্ধার করতেও কোনো ভূমিকা পালন করেনি। বারবার অনুরোধের পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর মোসলেম হুদার প্রশাসন দীর্ঘ সময় ধরে এ হত্যাকান্ডে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি নির্দেশ সেদিন ঘটনাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারতো। হয়ত জীবন দিতে হতো না চারজন নিরপরাধ মেধাবী শিবিরকর্মীকে। আহত হতে হতো না শত শত শিবির নেতাকর্মীকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ঘটনাসহ শিবির বিরোধী প্রতিটি ঘটনায় বাম ও রামপন্থী শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভূমিকা ছিল ন্যক্কারজনক।

ঘটনার পরবর্তী ফলাফল
“তারা মুখের ফুৎকারে আল্লাহর নূরকে নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তাঁর নূরকে পূর্ণরুপে বিকশিত করবেন যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।” (সূরা আস-সফ : ৮)
১৯৮২ সালের ১১ মার্চের হত্যাকান্ডের মাধ্যমে শিবিরকে উৎখাত করার হীনচক্রান্ত করেছিলো কিন্তু আল্লাহর অশেষ মেহেরবানিতে তাদের ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়েছে। ওরা আমাদের উৎখাত করতে পারেনি বরং শহীদের রক্ত মতিহারের সবুজ চত্বরকে করেছে উর্বর শহীদদের সাথীদের করেছে উজ্জীবিত। মতিহারের সবুজ চত্বর হয়েছে শিবিরের একক মজবুত ঘাঁটি। হত্যা, জুলুম নির্যাতন ইসলামী আন্দোলনের অগ্রযাত্রাকে আরো বেগবান করে, তা নতুন করে প্রমাণিত হয়েছে।

১১ মার্চের শহীদদের রক্ত বৃথা যায়নি। সেদিনের নৃশংসতা, আহতদের আহাজারি আর আর্তচিৎকার এবং আহত-শহীদের রক্ত প্রতিটি শিবিরকর্মীর প্রাণে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। শিবিরকর্মীরা ভাই হারানোর বেদনায় মুষড়ে পড়েনি। তারা শোককে শক্তিতে পরিণত করেছে। তারা শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে প্রয়োজনে নিজেদের জীবনকেও অকাতরে বিলিয়ে দেয়ার দীপ্তশপথ গ্রহণ করেছে। সেদিন সদম্ভে শিবিরের সাংগঠনিক তৎপরতা তারা নিষিদ্ধ করেছিল। শিবির নেতৃবৃন্দ এতে মোটেও বিচলিত হননি। সংগঠনকে আরো মজবুত করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নির্যাতিত নিপীড়িত ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে পাষন্ডদের নৃশংসতা তুলে ধরে। তুলে ধরে শিবিরকর্মীদের প্রকৃত অপরাধ ‘তারা আল্লাহর পথে কাজ করে’। তুলে ধরে মুসলমানদের বাংলাদেশে ইসলামের জন্য কাজ করার ব্যাপারে সন্ত্রাসীদের পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষণার প্রেক্ষাপট। সংগঠনের আদর্শিক সৌন্দর্য ও নিজেদের উন্নত আচরণ, উন্নত নৈতিক চরিত্রের মাধ্যমে শিবির পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের হৃদয়ে নিজেদের অবস্থান করে নেয়। রচিত হয় শিবিরের প্রাথমিক শক্তিশালী ভিত্তি। ধীরে ধীরে এলাকার মানুষের কাছে সন্ত্রাসীরা ঘৃণিত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিবির উৎখাত করার জন্য বহু ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কোন ষড়যন্ত্রে শিবির বিচলিত হয়ে যায়নি। আপোস করেনি। বাতিল চক্রান্তের দাঁতভাঙা জবাব দিতে কখনও শিবির পিছপাও হয়নি। শিবির কর্মীরা ইচ্ছা করলে ৪ শহীদের খুনিদের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে পারতো। কিন্তু তা করেনি তারা। অথচ এ ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসীদের সীমাহীন বাড়াবাড়ি যে কাউকে ধৈর্যহীন আর বিক্ষুব্ধ না করে পারে না। চারটি তরতাজা প্রাণ হত্যা করার পর হত্যাকারীদের পক্ষ থেকে মজলুমদের তৎপরতা নিষিদ্ধ করার যে ঘোষণা- তা স্বাভাবিকভাবে নেয়ার কথা নয়। কিন্তু চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে শিবির। শিবিরকর্মীরা মজলুমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, ফলে আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করেছেন এ ক্যাম্পাসে। আর আল্লাহ যদি কারো সাহায্য করেন তাহলে আর কারো সাহায্যের দরকার হয় না।

মতিহারের সবুজ চত্বর চারজন শহীদের খুনকে ধারণ করার যে দুর্লভ সুযোগ লাভ করেছে তা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে, এখানকার জনশক্তিকে করেছে মহিমান্বিত ও গৌরবের উত্তরাধিকারী। বাংলাদেশে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়দীপ্ত কাফেলা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রথম চারজন শহীদ হচ্ছেন ১১ র্মাচের শহীদ শাব্বির, হামিদ, আইয়ূব ও জব্বার। এভাবেই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরকর্মীরা ত্যাগ ও কোরবানির যে কঠিন নজরানা পেশ করেছেন তা দেশের লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার হৃদয়ের গভীরে স্থান করে নিয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতা এ কাফেলার দিকে ধাবিত হয়েছে। সেদিন স্বাধীন বাংলাদেশে শাহাদাতের যে সূচনা হয়েছিল শাহাদাতের সেই মিছিল বড় হয়েই চলেছে। শহীদদের মিছিল যতই বড় হয়েছে লক্ষ তরুণ প্রাণ শিবিরের আহবানে ততই সাড়া দিয়েছে। শিবির আজ বাংলাদেশের শক্তিশালী ও সুসংগঠিত একটি অপ্রতিরোধ্য কাফেলার নাম। আলহামদুলিল্লাহ!

ছাত্রশিবিরের প্রথম নজরানা
এমনি মুহূর্তে বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে শহীদ শামসুজ্জোহার কবরের সামনে শিবির নেতা, উপশহরের কৃতি সন্তান সাব্বিরের ওপর নারকীয় হামলা চালায়। রড-কিরিচ-রামদার শত শত আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে রাজশাহী মেডিক্যালে ভর্তি করা হলো। মুয়াজ্জিনের কণ্ঠে আজানের পাশাপাশি করুণ সুরে ভেসে এলো সাব্বির আর নেই! শিবিরের সর্বপ্রথম শহীদ হিসেবে জান্নাতুল ফিরদাউসের জামায়াতে প্রভুর কাছে হাজির হয়ে গেলেন। কান্না আর বুকফাটা আহাজারি!

শত শত নেতাকর্মী আহত আর রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। শত জনতার সম্মুখে বিএনসিসির সামনে শিবিরে নেতা আব্দুল হামিদের মাথার নিচে ইট রেখে অনেক ইট আর রড দ্বারা আঘাত করলে মগজ ছিটকে বের হয়ে যায়। পশু জবেহ করার পরে যেমন ছটফট করে তেমনি আবুদল হামিদের মগজ গলিত অবস্থা ছটফট করতে করতে লাফ দিয়ে রক্তধারা দেওয়ালে রেখে যান। রাজশাহী কলেজ থেকে আরবি অনার্স পরীক্ষা দেয়া আর হলো না। শহীদ আবদুল হামিদের রক্তমাখা বেদনার প্রতিচ্ছবি প্রতিক্ষণ প্রাণে দোলা দেয়। মনে পড়লেই হৃদয়ে জাগে শিহরণ! কিন্তু পাষাণ নিষ্ঠুরদের হাতও কাঁপেনি। যদিও কেঁপেছিল খোদায়ী আরশ। শহীদ সাব্বিরের শোকে মূহ্যমান আবাল বৃদ্ধবনিতা এক শহীদের বেদনায় শোকাহত জনতার প্রাণে শহীদ আবদুল হামিদের শাহাদাত চতুর্দিকে বাতাসের মত ছড়িয়ে পড়লো। আবারো কান্না, আহাজারি আর চিৎকার।

১১ মার্চের বেদনার আধার ভেদ করে ১২ মার্চের সোনালি সূর্য উদিত হলো। মাত্র ৩৫ ঘণ্টার ব্যবধানে আহত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ মার্চ প্রভুর ধ্যানে পাড়ি দিলেন শহীদ আইয়ূব। উদ্ভিদ পরীক্ষায় অনার্স না হলেও শাহাদাতের মর্যাদায় হলেন উদ্ভাসিত। শহীদ সাব্বির, হামিদ যেমন শহর শাখার জোন সভাপতি ছিলেন তেমনি শহীদ আউয়ুবও ছিলেন শহর শাখার অফিস সম্পাদক। তাঁর হাসিমাখা চাহনি, অপূর্ব ওয়াল রাইটিং আর মায়াবী চেহারা বেদনার প্রতিচ্ছবি আজও ডাকে বারে বার। তিনিও চলে গেলেন ওপারে সুন্দর ভুবনে। প্রতিদিন সূর্য ফেরে শুধু ওরা ফেরে না...? দীর্ঘদিন আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকলেন রসায়ন বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবদুল জব্বার। কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়ি যান। প্রায় গান গেয়ে স্বান্তনা খুঁজতেন এভাবে আমাকে শহীদ করে সেই মিছিলে শামিল করে নিও. ‘আমার যাবার সময় হলো দাও বিদায়।' তার প্রাণের আকুতি ৯ মাস পর ২৮ শে ডিসেম্বর প্রভুর দরবারে কবুল হলো। তিনিও শাহাদাতের পিয়ালা পান করলেন। শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুবের মত শহীদ জব্বারের শাহাদাতেও পারলো না কেউ অশ্রু নিবারণ করতে। শহীদ আর অগণিত আহত, ক্ষত-বিক্ষত রক্তমাখা প্রতিচ্ছবি সত্যিই বেদনাবিধুর!

সেদিনের শহীদদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
জামিল খানের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় ছিলেন শহীদ সাব্বির আহমদ। রাজশাহীর বোয়ালিয়া থানার অর্ন্তগত উপশহরে আবাসিক এলাকায় পুরাতন ধরনের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ছিমছাম বাড়িতে বসবাসরত পরিবারে সাব্বির ছিলেন তখন ১৮ বছরের পরিশ্রমী আর প্রাণবন্ত তরুণ। তিনি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছবার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
পিতা নাসির উদ্দিনের সাত সন্তানের মধ্যে সবার বড় আবদুল হামিদের একরাশ সোনালি স্বপ্ন নিয়ে দানারহাট মাদরাসা থেকে দাখিল সম্পন্ন করেন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন রাজশাহী কলেজের আরবী বিভাগে।
পিতা মুহাম্মদ আইজুদ্দিনের আট সন্তানের সবার বড় আইয়ুব আলী। অত্যন্ত মেধাবী শহীদ আইয়ুব আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় বাদেমাজ স্কুলে। শাহাদাতের সময় রাজশাহী কলেজে উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
শহীদ আব্দুল জব্বার নওগাঁ জেলার ধামইরহাট থানার চকময়রাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা জমির উদ্দিনের ৬ সন্তানের সবার বড় ছিলেন। তিনি চকময়রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। শাহাদাতের সময়ে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

প্রাত্যহিক জীবন
শহীদ সাব্বির, হামিদ, আইয়ুব ও জব্বার ভাইয়ের প্রাত্যহিক জীবনাচরণ আমাদের প্রেরণার ও অনুসরণীয়। আদর্শবান ছাত্র হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে ইসলামী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহনের মাধ্যমে নিজের মেধা, মননশীলতা, সচ্চরিত্র অবলম্বন করে প্রাণপ্রিয় সংগঠনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রত্যয়ের পাশাপাশি প্রাত্যহিক আচরণ, চালচলন, কথাবার্তায় ইসলামের সুমহান শান্তির অকপট দীপ্তিতে ভাস্বর ছিলেন। এলাকার শিশু, কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ নির্বিশেষে সবার মাঝে অত্যন্ত মিষ্টভাষী হিসেবে পরিচিতি করে তুলেছিলেন নিজেদেরকে। প্রভুর কাছে সঁপে দিয়েছিলেন নিজেদের। তাদের ইসলামী অনুশাসনের প্রতি প্রবল ঝোঁক ও আন্তরিকতা পরিলক্ষিত হয়েছে শৈশব থেকেই। আদর্শ মুমিনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি হিসাবে শৈশব থেকেই নিয়মিত নামাজ পড়তেন। শুধু তাই নয়, তাদের চোখে-মুখে ছিল ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সোনালি স্বপ্ন।

বিভিন্ন মহলের প্রতিক্রিয়া
১৩ তারিখ পত্রপত্রিকায় এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রায় সব কটি রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন ও বুদ্ধিজীবী মহল বিবৃতি দিয়েছিল। সম্পাদকীয় লেখা হলো নারকীয় হত্যাকান্ডের ভয়াবহতা উল্লেখ করে। পত্রিকার পাতায়, মিছিলে, প্রতিবাদ সভায় সর্বত্র হত্যাকান্ডের জন্য বিশেষভাবে দায়ী রাবি’র ভিসি’র অপসারণ ও যারা এ নৃশংস হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে বর্বর পৈশাচিকতার পরিচয় দিয়েছে তাদের শাস্তির দাবি উঠলো, দাবি উঠলো ‘খুনিদের ফাঁসি চাই’। সামরিক আদালতে দায়সারা গোছের সাজা হয়েছিলও বটে কিন্তু জেনারেল এরশাদ খুনিদের মাফ করে দেওয়ায় সেই শাস্তি আর কার্যকর হয়নি।

আজও স্বপ্ন দেখেন শহীদ হামিদের মা
শহীদের মা হামিদা বেগমের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তার সাথে তো আমার প্রায়ই কথা হয়।’ একদিন বাড়ির পাশের গাছের ডাল ভেঙে হামিদা বেগমের পায়ে পড়লে পা ফুলে যায়। ব্যথায় কষ্ট পেতে থাকেন। ঠিক সে সময় শহীদ আব্দুল হামিদ এসে বললেন, ‘মা, এভাবে কষ্ট করছেন কেন?’ ঘটনা জেনে তিনি পায়ে তিনটি ফুঁ দেন। পরদিন থেকে পা আগের মতো সুস্থ হয়ে যায়। এভাবেই আরেক দিন স্বপ্নে এসে তাঁর প্রিয় বাবা কতদিন আগে মারা গেছে এবং ভাইদের কে কী অবস্থায় আছে তা জানতে চান। ঠিক এভাবেই একদিন স্বপ্নে মাকে নানীর বাড়ি বেড়িয়ে নিয়ে আসেন। মায়ের শারীরিক খোঁজ-খবরের সাথে সাথে আত্মীয়-স্বজনদের কে বেঁচে আছে আর কে মারা গেছে তা জানতে চান। এমনিভাবে আরো একদিন স্বপ্নে আব্দুল হামিদ এলে মা তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ? তিনি বললেন, আমি ভালো আছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না।

শাহাদাতের পূর্বে শহীদের কথা
গুন্ডাবাহিনী যখন তাঁকে উপর্যুপরি আঘাত করছিল আর বলছিল, বল শালা আর শিবির করবি কি না, শিবির না করলে তোকে ছেড়ে দেব। তখন খুনিদের কথা শুনে শহীদ আব্দুল হামিদ বলেছিলেন, ‘আমি যে সত্য পেয়েছি, আমি যে আলো পেয়েছি, ইসলামের পথ পেয়েছি, তা থেকে আমি দূরে থাকতে পারবো না।’

ফিরে আসে ১১ মার্চ
প্রতিবছর ফিরে আসে ১১ মার্চ। সেই সাথে ফিরে আসে শাহাদাতের কথা। দেশের তৌহিদী জনতার মনের পর্দায় ভেসে থাকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রক্তে রঞ্জিত মতিহার চত্বর। কাফেলার সৈনিকগণ এই শাহাদাত থেকে শিক্ষা নেয় সামনে এগিয়ে যাওয়ার, থমকে না দাঁড়ানোর। শহীদদের রক্ত রঞ্জিত পথ ধরেই এগিয়ে যাবে এ শহীদি কাফেলা। এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

আজো কাঁদায় শোকের ছায়ায়
১৯৮২ সালের ১১ মার্চের নারকীয় ঘটনায় জুলুম নির্যাতন আর আহতদের হৃদয়বিদারক করুণ দৃশ্যের অবতারণায় শোকের ছায়া নেমে আসে। সবার বিবেক স্তব্ধ হয়ে যায়। পত্রিকা, রেডিও, টিভি প্রচার মিডিয়াসহ সর্বমহলে এই নৃশংস ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচিত হয় ধারাবাহিকভাবে! ফলে শিবিরের প্রতি বিবেকবানদের মানবিক সহানুভূতি আলৌকিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। সরকারি বেসরকারি হাজার জনতার উপচেপড়া ভিড় আর আহতদের ক্ষত-বিক্ষত দেহ গগনবিদারী আহাজারির দৃশ্যাবলী অবলোকন করে কেউ পারেনি অশ্রু নিবারণ করতে।

ছাত্রনেতা মামুন ভাইয়ের ১৫দিন পর্যন্ত জ্ঞান ছিল না এবং কোন কিছু স্মরণ করতে পারতেন না। এই বর্বর অমানবিক ঘটনার জন্য তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারও ছুটে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনিও তীব্র প্রতিবাদ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। আর অজ্ঞান মামুনের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি হেলিকপ্টার যোগে ঢাকা সামরিক-হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশ দেন। রাষ্ট্রপতির মহতি উদ্যোগ এবং শিবিরের নেতা কর্মীদের ত্যাগ কুরবানি সর্বোপরি শাহাদাতের ঘটনা শিবিরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। ইসলামী ছাত্রশিবির এই ১১মার্চকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।

১৯৮২ সালের ১১ মার্চ যেই আলো নিভিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল তা আজ লাখো তরুণের পথের দিশা। শত জুলুম, নির্যাতন উত্তাল তরঙ্গমালার এক সাগর রক্ত পেরিয়ে আল্লাহর দ্বীনের বান্দারা আজ মিলিত হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবিরে। লাখো নাবিক আর পথহারা যুবকের দল ভিড় জমাচ্ছে এই কাফেলা বিপ্লবী মিছিলে। শত শত বেদনার প্রতিচ্ছবি ইসলামী আন্দোলনের রন্ধ্র্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।

নতুন করে জেগে ওঠার দিন
আমি তোমাদের কারো কর্মকা- নষ্ট করবো না। পুরুষ হও বা নারী, তোমরা সবাই একই জাতির অন্তর্ভুক্ত। কাজেই যারা আমার জন্য নিজেদের স্বদেশ ভূমি ত্যাগ করেছে এবং আমার পথে যাদেরকে নিজেদের ঘর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া ও কষ্ট দেয়া হয়েছে এবং যারা আমার জন্য লড়েছে ও মারা গেছে, তাদের সমস্ত গোনাহ আমি মাফ করে দেবো এবং তাদেরকে এমন সব বাগানে প্রবেশ করাবো যার নিচ দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে। এসব হচ্ছে আল্লাহর কাছে তাদের প্রতিদান এবং সবচেয়ে ভালো প্রতিদান আল্লাহর কাছে আছে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত নং- ১৯৫)

কবি মতিউর রহমান লিখেছেন-
আশাহত হয়ো নাকো তুমি/ না হয় হলো মন শুকনো কোন মরুভূমি

জুলুম নির্যাতন দিন দিন বেড়ে চলেছে। তবে আমরা কিন্তু হারিয়ে যায়নি। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের সীমাহীন ত্যাগ কুরবানির উপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় কাফেলা। আমার বিশ^াস জুলুম নির্যাতন করে কেউ রক্ষা পায়নি। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনি। যারা অন্যায়ভাবে তৌহিদী জনতার উপর জুলুম চালিয়ে যাচ্ছে একদিন তাদেরকে আদালতের কাঠগড়ায় উঠতে হবে। বাংলাদেশে ইসলামী আন্দোলনের বিজয় অবশ্যম্ভাবী। তাই আসুন নতুন করে জেগে ওঠি। কবি গোলাম মোহাম্মদের আহবানের সাথে আমরাও কণ্ঠ মিলাই-

সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে/ আমাকেও রাখিও রহমান
যারা কোরআনের আহবানে নির্ভীক/ নির্ভয়ে সব করে দান।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতিহারের সবুজ চত্বরে প্রতি ফোঁটা রক্তের প্রতিদান আল্লাহপাক দিয়েছেন। ১১ র্মাচের পর শিবিরকর্মীদের অনেক ত্যাগ ও কোরবানি পেশ করতে হয়েছে কিন্তু শিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান ছাত্রসংগঠনে পরিণত হয়েছে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত শিবিরের কর্মকান্ড ছড়িয়ে পড়ে। ওরা চেয়েছিল খুন করে শিবিরকর্মীদের দাবিয়ে দিতে কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয়েছে। শিবিরের সংগঠন অনেক বিস্তৃতি লাভ করেছে। ওদের গুলি, বোমা আমাদের ভাইদের গতিকে স্তব্ধ করে দিতে পারেনি বরং আরো বেগবান হয়েছে। তাই কুরআনের চিরন্তন সেই বাণীর কথা স্মরণ করতে হয়- “যারা আল্লাহর পথে নিহত হয় তাদেরকে মৃত বলো না, তারা জীবিত কিন্তু তোমরা বুঝতে পার না।”

১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শাহাদাতের যে মিছিল শুরু হয়েছিলো ২০১৮ সালে তার যাত্রী সংখ্যা ২৩৪ জন। শহীদি ঈদগাহ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই আজ পর্যন্ত ২১ জন ভাই শাহাদাত বরণ করেছেন। হত্যা করে, জুলুম নির্যাতন করে, কারাগারে প্রেরণ করে ইসলামের শত্রুরা চেয়েছিল শহীদি কাফেলা ইসলামী ছাত্রশিবিরকে চিরতরে নিঃশেষ করতে। কিন্তু তাদের এ পদক্ষেপ বরং ইসলামী ছাত্রশিবিরের অগ্রযাত্রাকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করেছে। ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মত্যাগের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত উপস্থাপিত হয়েছিল আজ সারা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি প্রান্তরে ইসলামপ্রিয় তরুণ সমাজ সেই ত্যাগের নজরানা পেশ করছে। লাখো লাখো তরুণ আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টায় লিপ্ত। বন্দুকের গুলি, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, কারাগারে প্রেরণসহ শাসকগোষ্ঠীর সকল নিষ্পেষণের হাতিয়ারকে উপেক্ষা করে ইসলামী আন্দোলনকে তার কাঙ্খিত মঞ্জিলে পৌঁছে দেয়ার জন্য আজ ইসলামপ্রিয় তরুণ ছাত্রসমাজ ইসলামী ছাত্রশিবিরের পতাকাতলে আশ্রয় নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ইসলামী আন্দোলনের কাজ আল্লাহ তাআলার কাজ। তাই বাতিলের যতই বাধা আসুক না কেন, এ আন্দোলনকে থামাতে তো পারবেই না বরং তাদের বাধার পরিমাণ যত বাড়বে আন্দোলনের গতি তত তীব্র থেকে আরো তীব্রতর হবে। ইনশাআল্লাহ। ছাত্রশিবির যেন প্রত্যাশিত মঞ্জিলে এগিয়ে যেতে পারে, সে তৌফিক আল্লাহর কাছে কামনা করছি।

“আমাদের প্রত্যয় একটাই আল্লাহর পথে মোরা চলবো
নিকষ কালিমা ভরা আকাশে ধ্রুবজ্যোতি তারা হয়ে জ্বলবো”

লেখক : সেক্রেটারী জেনারেল, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

সংশ্লিষ্ট