বুধবার, ০৫ এপ্রিল ২০১৭

অ্যাডভোকেট সাবিকুন্নাহার মুন্নী

আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কথা বলা কি অপরাধ?

একজন মুসলমান কালেমা তাইয়্যেবা পাঠ করে, এর অর্থ গভীরভাবে হৃদয়ে অনুধাবন করে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে। কালেমা তাইয়্যেবায় যে ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র ঘোষণা প্রদান করা হয় তার অর্থ হলো- ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই’। একজন মুসলমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে নিজের রব হিসেবে ঘোষণা করে তার প্রভুত্ব মেনে নিয়ে ঈমানের শর্তসমূহ মেনে চলার ঘোষণা দেয়।

এই বিশাল পৃথিবীর আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সব কিছুর মালিক আল্লাহ্। আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবাই আল্লাহর প্রশংসা করছে। তিনি সমস্ত রাজ্যের মালিক। তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। নিয়ন্ত্রণও করছেন তিনিই। তারই বিধান আসমান এবং জমিনের সর্বত্র বিদ্যমান। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ, বাতাস তারই নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছে। এ সবকিছুকে নিয়েই মহান আল্লাহর বিশাল রাজত্ব। এখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান। তার রাজত্বে তিনি নিরঙ্কুশ। তার কোন অংশীদার নেই, তিনি লা শরিক। তিনি কাউকে জন্ম দেন নাই, কেউ তাকে জন্ম দেয়নি। কেউ তার সমকক্ষ নয়।

আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানের ভাষায়, সার্বভৌমত্বের ধারণা সকলের নিকট স্পষ্ট। চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী কর্তৃপক্ষই হচ্ছেন সার্বভৌমত্বের মালিক। কোরআন এবং হাদীসের দৃষ্টিতে সকল ক্ষমতার উৎস হচ্ছে মহান রাব্বুল আলামীন। তিনি সর্বশক্তিমান। রাজাধিরাজ। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্থলে মানুষকে সার্বভৌম শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে চরম অন্যায়। কোরআন তাকে খোদাদ্রোহী তাগুত বলে আখ্যায়িত করেছে। মহান আল্লাহ তায়ালা তাগুতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ আল্লাহর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানী দায়িত্ব।

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী একটি ইসলামী সংগঠন। একটি পরিপূর্ণ ইসলামী আন্দোলন। জামায়াতের গঠনতন্ত্রের ভূমিকায় বলা হয়েছে ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ নেই, এবং নিখিল বিশ্বের সর্বত্র আল্লাহর প্রবর্তিত প্রাকৃতিক আইনসমূহ একমাত্র তারই বিচক্ষণতা ও শ্রেষ্ঠত্বের সাক্ষ্য দান করিতেছে।’ গঠনতন্ত্রের মৌলিক আক্বীদা অধ্যায়ে ২ নং ধারায় ইসলামের মৌলিক আক্বীদা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, অর্থাৎ- আল্লাহ ব্যতীত কোন ইলাহ্্ নেই, মোহাম্মদ (সা) আল্লাহর রাসূল’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ২(৫) তে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহাকেও বাদশাহ, রাজাধিরাজ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক মানিয়া লইবে না। কাহাকেও নিজস্বভাবে আদেশ ও নিষেধ করিবার অধিকারী মনে করিবে না। কেননা স্বীয় সমগ্র রাজ্যের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও সৃষ্টিলোকের সার্বভৌমত্বের অধিকার আল্লাহ ব্যতীত অপর কাহারও নেই।’ জামায়াতের এই মৌলিক আক্বীদা কুরআন ও হাদিস থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। কোন মুসলমান এই আক্বীদা অস্বীকার করতে পারে না।

একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে এই আক্বীদা ও বিশ্বাসের ঘোষণার মাধ্যমে মূলত সংগঠনের ইসলামী বিশ্বাস ও আক্বীদার পরিস্ফুটন ঘটানো হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২(ক) ধারায় রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম।’ সংবিধানের প্রস্তাবনার শুরুতেই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ উল্লেখ করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৭ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার দেয়া হয়েছে। ৩৮ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার অধিকারের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। ৩৯(১) ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে। ৪১ ধারা অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের যেকোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে। সংবিধানের এসব ধারায় ইসলাম ও ধর্মীয় অনুশাসন অনুসরণ করার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়নি। সুতরাং সংবিধান অনুযায়ী ইসলামী বা ধর্মীয় সংগঠন করার অন্তরায় সৃষ্টি করার কোন সুযোগ নেই।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান মেনে মৌলিক বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে শোষণমুক্ত ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের মহান উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন করেছে। ইসলামী আক্বীদা ও বিশ্বাসের অনুসরণ করতে গিয়ে জামায়াতের গঠনতন্ত্রকে সংবিধান পরিপন্থী বলা নিতান্ত্যই দুর্ভাগ্যজনক। একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের প্রতিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। সব সংসদেই জামায়াতের প্রতিনিধিত্ব ছিল, বর্তমান সংসদেও আছে। ২০০৮ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে। নির্বাচন কমিশন সন্তুষ্ট হয়ে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধিত করে। ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটবদ্ধভাবে জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। যে কয়টি আসনে জামায়াত মনোনিত প্রার্থীগণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করেন তাদের প্রত্যেক আসনে ১ লাখেরও অধিক করে ভোট পান।

২০০৯ সালে তরিকত ফেডারেশন মহামান্য হাইকোর্টে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের জন্য একটি রীট পিটিশন দায়ের করে। ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার তথাকথিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মাননীয় ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করে। এরপর শাহবাগ চত্বরে কিছু নাস্তিকদের উদ্যোগে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গণজাগরণ মঞ্চ গঠিত হয়। উক্ত মঞ্চ থেকে অন্যান্য দাবির সাথে জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি উচ্চারিত হয়। মাননীয় আইনমন্ত্রী ২০০৯ সালের হাইকোর্টের রীটটি নিষ্পত্তি করে জামায়াত নিষিদ্ধের পদক্ষেপ নেয়া যায় মর্মে এক সভায় ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা মোতাবেক ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বৃহত্তর বেঞ্চ গঠন করে তরিকত ফেডারেশন কর্তৃক দায়েরকৃত রীট পিটিশনটির শুনানি শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবে ধরে নেয়া যায় এই মামলাটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের হাতিয়ার হিসেবে তা নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়া হয়। দীর্ঘ শুনানির পর ১২ জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়। মহামান্য হাইকোর্টের ছুটির ঠিক আগের দিন আদালতের সেশন চলার সর্বশেষ মুহূর্তে রীট মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে রমযানের শেষ দিকে ঈদুল ফিতরের পূর্ব মুহূর্তে ছুটির আগের দিন কেন রায়ের জন্য সময়টি বেছে নেয়া হলো? এই রায় ঘোষিত হলে রাজনৈতিক কারণে জামায়াত কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তাতে ব্যাপক জনদুর্ভোগ হতে পারে এটা জানা সত্ত্বেও রায়ের সময় নির্ধারণটি জনমনে ব্যাপক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। আবশ্য কোন মামলার রায় কখন ঘোষিত হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব আদালতের। তার পরও সামগ্রিক পরিস্থিতি অবশ্যই মূল্যায়নের দাবী রাখে। মহামান্য হাইকোর্টের বৃহত্তর ডিভিশন বেঞ্চ এক বিভক্তি রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে।

নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য রাজনৈতিক দলসমূহের নিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ সিদ্ধান্ত নেয় তারা কোন দলকে ভোট দেবে। এটাই গণতন্ত্রের মূল কথা। বাংলাদেশের পরিবর্তিত সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’ বহাল আছে। এমতাবস্থায় ধর্মীয় দল হিসেবে জামায়াতের রাজনৈতিক নিবন্ধন বাতিল করার কোন সুযোগ নেই। এ রায়ে আইনের শাসন, গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার ও সংবিধানের উপর আঘাত হানা হয়েছে। পৃথিবীর কোন দেশেই রাজনৈতিক দলের আদর্শের উপর আঘাত হানার কোন ধরনের নজির নেই। ঈড়সসঁহরংঃ চধৎঃু ড়ভ ওহফরধহধ’র একটি মামলা যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টে বিচারাধীন ছিল। ঐ মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্ট বলেন, কমিউনিস্ট আদর্শ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে হলেও সংবিধান প্রদত্ত রাজনৈতিক স্বাধীনতার নিশ্চয়তার কারণে কোন ধরনের নিয়ন্ত্রণ সঠিক হবে না। সুপ্রীম কোর্ট সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর বরাত দিয়ে বলেন, কোন রাজনৈতিক দলের আদর্শ বা বিশ্বাসে বিপজ্জনক কিছু থাকলেও যতদিন রাজনৈতিক স্বাধীনতা থাকবে সুপ্রীম কোর্ট ততদিন রাজনৈতিক দলের উপর নিয়ন্ত্রণ বা হস্তক্ষেপ করবে না। এসব নজির সামনে রেখে বাংলাদেশের মহামান্য হাইকোর্টের প্রদত্ত রায় বিশ্লেষণ করলে আমাদের হতাশ হতে হয়।

প্রশ্ন জাগে, শুধুমাত্র জামায়াতের নিবন্ধনই কি বেআইনী? ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে নির্বাচন কমিশন তাদের একটি মেমোতে উল্লেখ করেন যে, দু’টি দল ছাড়া বাকি যে ১১টি দলকে নিবন্ধন দেয়া হয়েছে সবারই গঠনতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর সাথে সাংঘর্ষিক। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এই ১১টি দল ছাড়াও আরো কয়েকটি দলকে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দিয়েছে। যাদের গঠনতন্ত্র ত্রুটিপূর্ণ। জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে মাননীয় আদালত যে ধারার সূচনা করলেন অন্যান্য দলের ক্ষেত্রেও তা যদি প্রয়োগ করা হয় তাহলে অনেকগুলো দলের নিবন্ধন বাতিল হবে। গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনের জন্য এর পরিণতি হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আইন সকলের জন্য সমান। গঠনতন্তের ত্রুটির কারণে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলে অন্য দলের নিবন্ধন বাতিলের ক্ষেত্রে আদালত কি করবে? রাজনৈতিক বিষয়সমূহ আদালতে টেনে আনা দেশের শান্তি-স্থিতিশীলতার জন্য প্রচ- হুমকি। রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন সংক্রান্ত বিষয়ে দেখাশুনার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। আমাদের জানামতে, জামায়াতের নিবন্ধনের আনুষ্ঠানিকতা নির্বাচন কমিশনের সাথে সম্পন্ন হওয়ার পূর্বেই রীট মামলাটির শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। সুতরাং অপরিপক্ব রীট আবেদনের শুনানি আদালতে সম্পন্ন করার কোন সুযোগ নেই। বাংলাদেশ, ভারত এবং ইংল্যান্ডের উচ্চতর আদালতের এমন অনেক নজির রয়েছে।

বিভক্তি রায়ে জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার পর মহামান্য হাইকোর্ট আপিলের সার্টিফিকেট প্রদান করায় সংবিধানের ১০৩ ধারা অনুযায়ী এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি সুপ্রীম কোর্টে সম্পন্ন হবে। সুতরাং নিবন্ধন বাতিলের ব্যাপারে সুপ্রীম কোর্টের চূড়ান্ত রায়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পাশাপাশি সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের অধীনে জামায়াত একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করতে পারবে।

নিবন্ধন বাতিলের পর জনগণের মাঝে প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে, আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণার কারণেই কি জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল হলো? যদি তাই হয় তাহলে দেশের ৯০ ভাগ মুসলমান যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বে বিশ্বাসী, নিবন্ধন বাতিল করে তাদের বিশ্বাসের উপর আঘাত হানা হয়েছে। এতে জামায়াতের প্রতি ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ভালোবাসা ও সহানুভূতি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। নিবন্ধন বাতিলে জামায়াতের কোন ক্ষতি হয়নি। বরং এর দায় দায়িত্ব আওয়ামী নেতৃত্বাধীন সরকারের উপর বর্তিয়েছে এবং আওয়ামী লীগ চিহ্নিত হয়েছে ধর্মদ্রোহী শক্তি হিসেবে।

সংশ্লিষ্ট