রবিবার, ০২ এপ্রিল ২০১৭

শাহ মোহাম্মদ মাহফুজুল হক

পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে একজন দায়িত্বশীলের ভূমিকা

ইসলামী সংগঠনে দায়িত্বশীল তথা নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম। নেতৃত্বকে কেন্দ্র করেই গোটা কর্মীবাহিনী আবর্তিত হয়। দায়িত্বশীল শব্দটির বাংলা প্রতিশব্দ হচ্ছে নেতা, পরিচালক। আরবিতে বলা হয় ইমাম, খলিফা, আমির এবং ইংরেজিতে Leader, Responsible person শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়।যিনি নির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে, কর্মসূচি ও কর্মপদ্ধতির আলোকে ময়দানের চাহিদা অনুযায়ী অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন এবং কর্মী পরিচালনা করেন তাকে দায়িত্বশীল বলে। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘A leader is he who knows the way, follows the way and shows the way. দায়িত্বশীল বা ইমাম হচ্ছে ঢালস্বরূপ, যাকে সামনে রেখে পথ চলা যায়।

হযরত আওফ ইবনে মালেক (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সা)-কে বলতে শুনেছি তোমাদের ঐসব নেতারাই উত্তম নেতা যাদেরকে তোমরা ভালোবাস এবং তারা তোমাদেরকে ভালোবাসেন। তোমরা তাদের জন্য দোয়া কর আর তারা তোমাদের জন্য দোয়া করেন। আর তোমাদের ঐসব নেতারাই নিকৃষ্ট নেতা যাদের প্রতি তোমরা বিক্ষুব্ধ এবং তারাও তোমাদের প্রতি বিক্ষুব্ধ। হযরত আয়েজ ইবনে আমের রা: থেকে বর্ণিত; তিনি বলেন, ‘একদিন হযরত উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদ আমার কাছে এসে বলেন, বাপু হে শোন! আমি রাসূলুল্লাহ (সা)কে বলতে শুনছি, নিকৃষ্ট দায়িত্বশীল ব্যক্তি হলো রাগি বদমেজাজি ব্যক্তি (অর্থাৎ পাষাণ দিলের মানুষ, যে তার অধীনস্থ লোকদের ওপর শুধু জুলুম করে, তাদের সাথে কখনো নরম ব্যবহার করে না, দরদ দেখায় না। খবরদার! আমি তোমাকে সাবধান করছি- তুমি যেন তাদের অন্তর্ভুক্ত না হও।’ (বুখারী ও মুসলিম)

সেশনের শুরুতেই একটি শাখার দায়িত্বশীলদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে শাখার সারা বছরের কাজের একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ এবং তা সুচারুরূপে বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। ইংরেজিতে বহুল প্রচলিত একটি উক্তি, ‘A good plan is half done of any work. বাস্তবিক পক্ষে আমরা দেখি যেকোনো কাজের শুরুতে একটি যথার্থ ও কার্যকর পরিকল্পনা নেয়া হলে ঐ কাজটি বাস্তবায়ন অনেক সহজ হয় এবং সর্বোচ্চ আউটপুট পাওয়া যায়। একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ ও তার সফল বাস্তবায়নের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করা দরকার ।

১. যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ
# কেন্দ্রীয় সংগঠন কর্তৃক গৃহীত পরিকল্পনা অনুসারে শাখার পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
# পূর্ববর্তী কয়েক বছরের পরিকল্পনা, ময়দানের বর্তমান অবস্থা ও প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করা।
# বর্তমান ও সাবেক অভিজ্ঞ দায়িত্বশীল ভাইদের সাথে পরামর্শ করা।
# পর্যাপ্ত সময় নিয়ে পরিকল্পনা তৈরি করা।
# সংগঠনের পাঁচ দফা কর্মসূচি ও বিভাগ সমূহকে সামনে রেখে প্রতিটি দফা ও বিভাগের জন্য পৃথক পৃথক পরিকল্পনা।

২. কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ। (Executive Plan)
# এ বছর যে সকল প্রতিষ্ঠান ও এলাকায় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হবে তার তালিকা তৈরি করে অধস্তন সংগঠন ও দায়িত্বশীলদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা।
# জনশক্তি মানোন্নয়নের (সদস্য, সাথী ও কর্মী) সংখ্যাতাত্ত্বিক পরিকল্পনার আলোকে নামের তালিকা তৈরি ও অধস্তন সংগঠন ও দায়িত্বশীলদের মধ্যে টার্গেট বণ্টন করে দেয়া।
# বার্ষিক পরিকল্পনাকে ষান্মাসিক, ত্রৈমাসিক, মাসিক ভিত্তিতে ভাগ করে কোন সময়ে কোন কাজ করা হবে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা।
# পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা। যেমন- দাওয়াতি দশকের পরপরই কর্মী গঠনের মাস পালন করা।

৩. পরিকল্পনা অবহিতকরণ। (Plan Understanding)
# সেক্রেটারিয়েট সদস্য ও অধস্তন দায়িত্বশীলদের সার্বিক পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেয়া।
# পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সকলের কাজ নির্দিষ্ট করা এবং অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।

৪. মূল দায়িত্বশীলের অগ্রণী ভূমিকা পালন।
# অন্যকে কাজ দিয়ে নিজে কাজের অংশ হতে হবে, নিজে ঘরে বসে থাকলে হবে না
# কাজ নিয়ে ময়দানে যাওয়ার পূর্বে Table Work করা।
# নিজের ভূমিকা ও পেরেশানির মাধ্যমে জনশক্তির আস্থা অর্জন করা।
# মূল দায়িত্বশীলের করণীয় হচ্ছে সংশ্লিষ্ট শাখার সেক্রেটারিয়েট, সদস্য, থানা সভাপতি ও সাথীদের সঠিক তত্ত্বাবধান করা ও সক্রিয় রাখা।

৫. যথাযথ তত্ত্বাবধান নিশ্চিত করণ। (Monitoring and Supervision)
# বৈঠকে আনুষ্ঠানিক তত্ত্বাবধানের বাইরেও একান্তে খোঁজখবর রাখা।
# কোন শাখায় সফরে গিয়ে তাড়াহুড়া করে বক্তব্য দিয়ে চলে না এসে সেখানে বসে তাদের প্রোগ্রামের আলোচ্য বিষয়, সুবিধা -অসুবিধা বুঝার চেষ্টা করা।
# যে সকল উপশাখায় নিয়মিত প্রোগ্রাম সমূহ বাস্তবায়ন হচ্ছে না তা মূল দায়িত্বশীলদের জানা দরকার এবং প্রোগ্রাম বাস্তবায়নে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করা।
# সংগঠন সম্প্রসারণ ও মানোন্নয়নের টার্গেট পূরণের জন্য প্রয়োজনে টার্গেট পুনর্বিন্যাস করা (টার্গেটকৃত এলাকা/ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পরিবর্তন করা এবং প্রয়োজনে তত্ত্বাবধানকারী দায়িত্বশীল পরিবর্তন করা)।
# কোথাও ত্রুটি পরিলক্ষিত হলে চিহ্নিত করা এবং দ্রুততম সময়ে সমাধান করা।

৬. পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর্যালোচনা। (Review)
# দায়িত্বশীল বৈঠকে বিগত মাসে গৃহীত পরিকল্পনার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে তা পর্যালোচনা করা।
# মাসের মাঝামাঝি সময়ে কয়েকজন বসে মাসিক পরিকল্পনার কতটুকু বাস্তবায়ন হয়েছে এবং কতটুকু বাকি রয়েছে তা পর্যালোচনা করা। মাসের শুরু ও মাঝামাঝি সময়ে খোঁজখবর না নিয়ে শেষে গিয়ে পর্যালোচনা ও কড়াকড়ি করলে সম্পর্ক খারাপ হয়, নতুন আসা দায়িত্বশীলরা ভয় পেয়ে যান এবং এতে কোন লাভ হয় না।
# সকল রিপোর্ট হতে হবে সঠিক ও তথ্যভিত্তিক। অনুমাননির্ভর কোন রিপোর্ট করা যাবে না।
# উপশাখার রিপোর্ট উপশাখায় তৈরি হতে হবে এবং পর্যালোচনা ওয়ার্ডে করতে হবে।
# গৃহীত বার্ষিক পরিকল্পনা যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য মূল দায়িত্বশীলকে সবসময় পরিকল্পনা কাছে রাখতে হবে এবং বাস্তবায়িত কাজের সাথে মিলিয়ে দেখতে হবে। এছাড়া ত্রৈমাসিক, ষান্মাষিক ও বার্ষিক আনুষ্ঠানিক পর্যালোচনা নিশ্চিত করতে হবে।

পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহ :
১. ব্যক্তিগত উদ্যোগে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের মধ্যে দাওয়াতি কাজকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া।
২. সংগঠন সম্প্রসারণ ও মজবুতি অর্জন এবং বেইজ এরিয়া তৈরি করা।
৩. স্কুল ও কলেজ কাজের প্রতি জোর দেয়া ও বাজেট বাড়ানো।
৪. সকলের জন্য মানসম্মত ও সময়োপযোগী প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা।
৩. বিদ্যমান পার্শ্ব সংগঠনসমূহকে (side organization)মজবুত করা এবং প্রয়োজনের আলোকে নতুন পার্শ্ব সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা।
৪. দাওয়াতি কাজের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ছাত্রকল্যাণ ও সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ এবং সংগঠনের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করা।
৫. সংগঠনের অভ্যন্তরীণ জান্নাতি পরিবেশ নিশ্চিত করা (ইনসাফ প্রতিষ্ঠা, রহমদিল হওয়া, পারস্পরিক ভালোবাসা, একে অপরের জন্য দোয়া করা, এহতেসাব ও পরামর্শের চর্চা বৃদ্ধি করা।)
৬. জনশক্তির মানোন্নয়নে কার্যকর পরিকল্পনা করা। (রিপোর্ট বা বাহ্যিক দিক দেখে নয় ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধান, ময়দানের ভূমিকা ও আত্মিক পরিশুদ্ধিতা দেখে মানোন্নয়ন করা)
৭. পরিকল্পিতভাবে সকল পর্যায়ে যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব তৈরি করা।
৮. আউটপুট পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৯. অনলাইন ব্যবহারে পর্দা মেনে চলা এবং নফসকে পরিশুদ্ধ রাখা।
১০. নিজেদের পরিবারকে অপসংস্কৃতির আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা।
১১. সকল পরিস্থিতিতে সংগঠনের কাজকে অব্যাহত রাখা। এক্ষেত্রে ত্যাগ-কোরবানির মানসিকতা নিয়ে কাজ করা।
১২. নফল নামাজ বিশেষ করে তাহাজ্জুদের নামাজ, নফল রোজা, অর্থ ব্যয় এবং সার্বক্ষণিক দোয়া ও জিকিরের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বৃদ্ধি করা।

উপরোক্ত বিষয়গুলো সামনে রেখে সুন্দর একটি পরিকল্পনা গ্রহণ ও পেরেশানি নিয়ে তা বাস্তবায়নে ময়দানে কাজ করলে মহান রাব্বুল আলামিনের সহযোগিতায় ইসলামী আন্দোলনের এই শহীদি কাফেলা তার লক্ষ্য অর্জনে অনেক দূর এগিয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশের এই সবুজ জমিনে বাতিলের মসনদ চূর্ণ করে দ্বীন ইসলাম প্রতিষ্ঠায় আল্লাহ তায়ালা আমাদের সফল করুন। আমিন

লেখক : সংগঠক ও মানবাধিকার কর্মী

সংশ্লিষ্ট