বৃহস্পতিবার, ২৩ জুন ২০১৬

আতিকুর রহমান

বদরের শিক্ষা- সর্বক্ষেত্রে সর্বাগ্রে মহান আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান এবং ভরসা করাই বিজয় অর্জনের মূল হাতিয়ার

আজ ১৭ই রমজান ‘বদর দিবস’। এই দিনে বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মক্কার মুশরিক এবং মুসলমানদের মধ্যে। বদর যুদ্ধ ইসলামে প্রথম যুদ্ধের ঘটনা। ইসলামের ইতিহাসে ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধের এই দিনটি একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যা ইসলামের ইতিহাসকে সোনালী রঙে রঙ্গিন করেছে। দ্বিতীয় হিজরীতে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয় যার নেতৃত্বে ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলিমরা সংখ্যায় অনেক কম হয়েও মক্কার কাফির শক্তিকে পরাজিত করেন। বদর যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের ধারাবাহিক বিজয়ের সূচনা হয়। এই যুদ্ধকে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী বলা হয় এবং মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে এই দিনকে ইয়াওমূল ফুরক্বান বলা হয়েছে। বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল মুসলমানদের আত্মরক্ষার্থে, সত্য-সুন্দরের পক্ষে, ইসলামের পক্ষে, নির্যাতিত-নিপীড়িতদের পক্ষে এবং মানবকল্যান নিশ্চিত করার জন্য।

আসুন সংক্ষেপে জেনে নেই এই মহান যুদ্ধের ইতিহাস।
মহান আল্লাহ ইসলামে প্রথম যুদ্ধের অনুমুতি দিতে গিয়ে বলেন-
“যুদ্ধে অনুমতি দেয়া হল তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম। যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ী থেকে অন্যায়ভাবে বহিস্কার করা হয়েছে শুধু এই অপরাধে যে, তারা বলে আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ। …” (কুরআন ২২:৩৯-৪০)।

বদর যুদ্ধে মুসলমানগণ ছিলেন তুলনামুলকভাবে দুর্বল। মুসলিম পক্ষে ছিল মাত্র ৩১৩ জন, অপরপক্ষে কাফেরদের সংখ্যা ছিল এক হাজারের অধিক। মুসলমানদের ৩১৩ জন সাহাবির মধ্যে ৮৫ জন ছিলেন মুহাজির সাহাবি; বাকি সবাই ছিলেন মদিনার আনসার। আনসারদের মধ্যে ৬১ জন আউস গোত্রের আর বাকি ৬৯ জন ছিলেন খাজরাজ গোত্রের। পুরো ৩১৩ জনের দলে উট ছিল ৭০টি আর ঘোড়া ছিল মাত্র দু’টি। অপরদিকে কাফেরদের এক হাজারের দলের ৬০০ জনের কাছে ছিল দেহ রক্ষাকারী বর্ম এবং তাদের কাছে ঘোড়া ছিল ২০০টি। যুদ্ধক্ষেত্রটিতে মুসলমানেরা যে স্থানটিতে অবস্থান নিয়েছিলেন সেখানে সূর্যের তেজ সরাসরি তাদের মুখের ওপরে পড়ে। কিন্তু কাফেরদের মুখে দিনের বেলায় সূর্যের আলো পড়ে না। মুসলমানেরা যেখানে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন সেখানের মাটি একটু নরম, যা যুদ্ধেক্ষেত্রের জন্য উপযুক্ত নয়। অপর দিকে কাফেররা যেখানে অবস্থান নিয়েছিলো সেখানের মাটি শক্ত এবং যুদ্ধের জন্য স্থানটি ছিলো উপযুক্ত।

এহেন সঙ্কুল পরিস্থিতিতে বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে আল্লাহ সুরা আনফালের ৩৬ নং আয়াতে কাফিরদের যুদ্ধের প্রস্ততি ও প্রত্যয় উল্লেখ করে মুসলমানদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য যুদ্ধের পরিনতির কথা জানিয়ে দিয়ে বলেন-
“নিঃসন্দেহে যেসব লোক কাফের, তারা ব্যয় করে নিজেদের ধন-সম্পদ, যাতে করে বাধাদান করতে পারে আল্লাহর পথে। বস্তুতঃ এখন তারা আরো ব্যয় করবে। তারপর তাই তাদের জন্য আক্ষেপের কারণ হবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা হেরে যাবে।”

এরপেই শুরু হয় বদরের লড়াই। মুসলমানরা মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে বীর বীক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েন কাফিরদের উপর। যুদ্ধ শুরু হবার পরে যখন যুদ্ধের তীব্রতা ভয়াবহ পর্যায়ে গেল সেসময় হজরত আবু বকর (রা.) দেখতে পেলেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাঁদছেন, আর আল্লাহর দরবারে বলছেন :
‘হে আল্লাহ! হাতেগোনা মুসলমানদের এই ছোট্ট দলটি যদি আজ শেষ হয়ে যায়, তাহলে এই দুনিয়ার বুকে ইবাদতের জন্য আর কেউ অবশিষ্ট থাকবে না। সুতরাং হে আল্লাহ! আপনি আপনার সেই সাহায্য অবতরণ করুন, যা দেয়ার অঙ্গীকার আপনি আমার সঙ্গে করেছেন।’ (বুখারী)

রাসূল সা. এর এই দোয়ার পরেই মহান আল্লাহ মুসলমানদের সান্তনা এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আয়াত নাযিল করে বলেন-
‘যখন তোমরা তোমাদের পালনকর্তার নিকটে কাতর প্রার্থনা করছিলে, তখন তিনি তোমাদের দো‘আ কবুল করলেন। আমি তোমাদেরকে সাহায্য করব এক হাজার ফেরেশতা দ্বারা, যারা হবে ধারাবাহিক ভাবে অবতরণকারী’। (সুরা আনফাল ৯)

‘যখন তোমাদের পরওয়ারদেগার নির্দেশ দান করেন ফেরেশতাদেরকে যে, আমি সাথে রয়েছি তোমাদের, সুতরাং তোমরা মুসলমানদের চিত্তসমূহকে ধীরস্থির করে রাখ। অচিরেই আমি কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব’। (সুরা আনফাল ১২)

অতঃপর যুদ্ধে মহান আল্লাহ’র প্রতিশ্রুত সাহায্য আসে এবং মুসলমানদের বিজয়ের মাধ্যমে বদরের যুদ্ধ সমাপ্ত হয়। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬জন মুহাজির ও ৮ জন আনছার অর্থাৎ ১৪ জন শহীদ হন। অন্যদিকে কাফেরদের পক্ষের ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয়। তাদের বড় বড় ২৪ জন নেতাকে বদরের একটি পরিত্যক্ত দুর্গন্ধময় কূপে (القليب) নিক্ষেপ করা হয়। হিজরতের প্রাক্কালে মক্কায় রাসূল (সা.) কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী আবু জাহল সহ ১৪ নেতার ১১ জন এই যুদ্ধে নিহত হয়। বাকী তিনজন আবু সুফিয়ান, জুবায়ের বিন মুতব‘ইম ও হাকীম বিন হেযাম পরে মুসলমান হন। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের হয় এবং বদর যুদ্ধের উদ্দেশ্য পূর্ণতা লাভ করে।

অলৌকিক এই বিজয়ের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে :
‘তোমরা (মুসলমানরা) তাদের হত্যা করনি; বরং আল্লাহই তাদের হত্যা করেছেন’। (সূরা আনফাল : ১৭)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’। (আলে ইমরান ৩/১২৩)

বদরের যুদ্ধের সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হল সব কিছুর জন্য সবার উপরে মহান আল্লাহর ওপর ভরসা বা তাওয়াক্কুল করা। এই যুদ্ধ প্রমান করে সংখ্যা ও যুদ্ধ সরঞ্জামের কমবেশী বিজয়ের মাপকাঠি নয়, বরং আল্লাহর উপরে দৃঢ় ঈমান ও তাওয়াক্কুল হল বিজয়ের মূল হাতিয়ার।

বদর যুদ্ধের পরই কাফিরদের প্রচেষ্টা থেমে যায়নি। বরং অব্যাহত রয়েছে আজ পর্যন্ত, এবং তাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। সুরা বাকারার ১১৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন-
‘বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সাথে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়’।
আবার একইসাথে মহান আল্লাহ মুমিনদেরকে সুরা আনফাল এর ৩৯ নং আয়াতে নির্দেশনা দিয়েছেন-
‘এখন তাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়ে যাও, যতক্ষণ ফেতনা ফাসাদ ও অরাজকতা দূর না হয় এবং সবাই একমাত্র আল্লাহর অনুগত না হয়ে যায়।’

বদরের যুদ্ধ মুসলমানদের শিখিয়েছে জাগতিক সকল প্রস্ততির পরেও বিজয় বা সাফল্যের জন্য নির্ভর করতে হবে একমাত্র মহান আল্লাহ’র ওপর। তবেই মহান আল্লাহর সাহায্য আসবে এবং বিজয়লাভ বা সফল হওয়া সম্ভব হবে। আল্লাহ তায়ালা সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও বদর প্রান্তরে মুসলমানদের বিজয় ও সফলতা দিয়েছেন, সেই অনন্ত স্রষ্ট্রা মহাপ্রভূ আল্লাহ একইভাবে সেসব ক্ষেত্রেও মুসলমানদের সাহায্য করতে সক্ষম, যখন একমাত্র মহান আল্লাহর উপর ভরসা করে সততা ও ইখলাস সহকারে তাঁর দ্বীনের বিজয়ে লক্ষ্যে মুসলমানরা এগিয়ে যাবে। এই এগিয়ে যাওয়ায় সেই অকুতোভয় মুজাহিদ বদরের সৈনিকদের কথা স্মরণ করে নিজেরাও প্রয়োজনে বদরের মতো যুদ্ধে যেতে পারি সেই শিক্ষাই আমাদের বদর দিবস থেকে নিতে হবে।
লেখকঃ কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির।

সংশ্লিষ্ট